চাকুরি না ফ্রিল্যান্সিং কোনটি করবেন? 1

দক্ষতা অর্জন করার পর যখন আপনি কাজ করার জন্য প্রস্তুত, তখন ক্যারিয়ারের জন্য দুটি পথ খোলা: চাকুরি না ফ্রিল্যান্সিং! এই দুইটি ক্যারিয়ারের কোনটিকে আপনি বাছাই করবেন, আজকের পর্বে আমরা সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।

১) ইচ্ছামত ঘুরি, ইচ্ছামত ঘুমাই

আপনি যখন চাকুরিজীবী: চাকুরি মানেই সকাল ৯টা – ৫টা পযন্ত অফিস করা। এমনকি এর চেয়েও বেশি সময় অফিস করা লাগতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আপনি নির্দিষ্ট সময় অফিস যাওয়ার পরও কখন অফিস থেকে ফিরবেন তার কোনো ঠিক নেই। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে অফিসে প্রবেশ করতে না পারা মানেই বসের ঝাড়ির জন্য অপেক্ষা, সেই সাথে মাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট একটা অংশ হিসেব করে কেটে নেওয়া। অফিসে প্রবেশের এই দেরিটা যানজট কিংবা অন্যকোন কারণেও হতে পারে।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: ফ্রিল্যান্সার হলে ইচ্ছামত সময়ে ঘুম, ইচ্ছামত সময়ে ঘুম থেকে উঠলেও কারো কাছে জবাবদিহী করতে হবেনা। শুধুমাত্র সময় অনুযায়ি বায়ারের কাজ জমা দেওয়াটাই আসল কাজ। সেটি দিনে করা হচ্ছে নাকি রাতে, সেটি কারও জন্যই টেনশনের বিষয় না।

২) হতে চাই নিজের বস

আপনি যখন চাকুরিজীবী: চাকুরি মানেই যেকোন কাজের ভুল কিংবা যেকোন অপরাধের জন্য বসের রুমে দুরু দুরু বুকে দাড়ানো, পরে সেই অপরাধের জন্য বসের মুখ থেকে অপমানজনক বোকাঝোকা শোনা। যেকোন চাকুরি জীবিদের জন্য এধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। একটা নির্দিষ্ট বয়স পযন্ত এই বিষয়টি মেনে নেওয়া গেলেও চাকুরি করার বয়সে এসে এধরনের অপমান গুলো সহ্য করা অনেক সময়ই মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হয়। কিন্তু অন্য কোন উপায় না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে অনেক সময় সবই মেনে নিতে হচ্ছে, শুধুমাত্র সুযোগের অপেক্ষা।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: ফ্রিল্যান্সার মানেই হচ্ছে নিজের বস নিজেই। কোন বসের বকাঝোকা খাওয়ার ভয় এ জগতে নেই। প্রয়োজন হলে কাজ কররো, প্রয়োজন না হলে নতুন করে কোন কাজে যুক্ত হবোনা। কাজ না করলে কারও কোন বাধা নাই।

৩) জগতটা ঘুরে দেখাটাই নেশা

আপনি যখন চাকুরিজীবী: চাকুরি জীবিদের ছুটির দিন, একদিন কিংবা সর্বোচ্চ দুইদিন। প্রতিদিন সকাল ৯টা -৫টা পযন্ত অফিস করার কারণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের ব্যক্তিগত কিংবা পরিবারের বিভিন্ন কাজের চাপ এসে পড়ে। এজন্য ভ্রমণ পিপাসুদের ভ্রমনের নেশাকে ভুলে যেতে হয়। মুক্ত পাখির মত বিশ্বব্যাপী ছুটে বেড়ানোর স্বপ্ন বাদ দিয়ে চাকুরির যান্ত্রিক জীবনটাকেই বেছে নিতে হয়।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: কোন জায়গাতে বসে বায়ারের কাজ করছেন এবং জমা দিচ্ছেন, সেটি ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নয়। আর এটাই হচ্ছেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের আসল মজা। ভ্রমনে বের হয়ে সমুদ্রের পাশে বসে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসেও বায়ারের কাজ সম্পন্ন করা যায়। ঘুরাঘুরি এবং কাজ দুটি সমান তালে করার সুযোগ রয়েছে ফ্রিল্যান্সারদের।

৪) দরকার বড় অংকের মাসিক আয়

আপনি যখন চাকুরিজীবী: চাকুরিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেতন হতে পারে ১০,০০০ টাকা কিংবা কারো বেশি হলে হয়তো ৫০,০০০টাকা হতে ১লাখ টাকা হতে পারে। কম টাকা বেতনের কারণে নিজের অনেক স্বপ্নকে মনের ভিতরেই কবর দিয়ে দিতে হয়। আবার এই টাকাতেই অনেকে হয়তো সন্তুষ্ট থাকতে পারেন। কারণ এর চাইতে বড় স্বপ্ন এখনও দেখতে পারছেন না।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: আমাদের দেশের অনেক ফ্রিল্যান্সার রয়েছে যারা ছাত্র অবস্থাতেই মাসে লাখ টাকার উপরে অনলাইন হতে আয় করছে। বাংলাদেশের একজন গ্রাজুয়েটের যেখানে চাকুরিতে মাসিক বেতন হয় ১০,০০০ – ২০,০০০টাকা। অন্যদিকে অনেক ফ্রিল্যান্সারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাদের মাত্র ১ সপ্তাহের আয়, অথচ সে ফ্রিল্যান্সার হয়তো এখন গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেনি।

৫) চাকুরির কারণে পরিবারকে মিস

আপনি যখন চাকুরিজীবী: পরিবারকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য চাকুরি শুরু করলেও, এই চাকুরি পরিবারের লোকদের প্রাপ্য স্নেহ, ভালবাসার নিশ্চয়তা দিতে পারেনা। সারাদিন অফিসের ব্যস্ততার জন্য অনেককেই দেখা যায়, পরিবারের লোকদেরকে সময় দিতে পারেন না। সন্তান, বউ কিংবা স্নেহের ছোট ভাইবোনরা আদর হতে বঞ্চিত হয়। সকাল ৯টা হতে অফিস শুরু করে যদি বাসাতে পৌছাতে রাত ১০টার পার হয়, তাহলে কিভাবে পরিবারের লোকজন আপনাকে পাশে পাবে।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: পরিবারের সবারই স্বপ্ন থাকে প্রতি বেলাতে সবাইকে সাথে নিয়ে এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার। চাকুরিজীবিরা পরিবারের মানুষদের এই দাবিটা মিটাতে না পারলেও ফ্রিল্যান্সারদের পক্ষে সম্ভব। কারণ ফ্রিল্যান্সারদের কোন অফিসে গিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয়না, কোন নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বন্দি থাকতে হয় না। চাইলে যখন ইচ্ছা পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখে আসতে পারে কিংবা বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলেও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বাধা নাই।

৬) মনতো চায় প্রতিষ্ঠানের মালিক হবো

আপনি যখন চাকুরিজীবী: হয়তো এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা, যারা চাকুরি করতে গিয়ে স্বপ্ন দেখেনা যে, সে নিজেই একদিন বস হয়ে নিজের একটি অফিস খুলে বসবে। এই ইচ্ছাটা কম বেশি সবারই মনে রয়েছে। মন চায়, অন্যের অফিসে চাকুরি করবো না, আমার নিজের অফিসে চাকুরি করবে অনেক জন, শুনবে সবাই আমার নির্দেশ,আমাকে কারও নির্দেশ শুনতে হবে না। কিন্তু এরকম হওয়াতো সম্ভব না। চাকুরি করে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটি দিয়ে নিজের চলতেই কষ্ট হয়, অফিসের স্বপ্ন দেখবো কিভাবে? অফিসের জন্য আয় করবোই বা কিভাবে?

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: একজন ফ্রিল্যান্সার জানে অনলাইন থেকে কিভাবে কাজ যোগাড় করা যায়। ১ থেকে ২ বছর যাওয়ার পর অনেক ফ্রিল্যান্সারদের কাজের চাপ বেড়ে যায়। তখন সেই কাজ করানোর জন্যই বাধ্য হয়ে লোকজন খুজে নিতে হয় বা নিয়োগ দিতে হয়। তখন পূরণ হয় আপনার বহুদিনের বস হওয়ার স্বপ্নটি।

৭) যানজট কমিয়ে দিচ্ছে কাজের সময়

আপনি যখন চাকুরিজীবী: প্রতিদিন অফিসে যেতে এবং আসতে যানজটের কারণে অনেক সময় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। কিছুই করার নাই, ঢাকা শহরে থাকতে হলে এবং অফিসে গিয়ে চাকুরি করতে হলে এটা মেনে নিতে হবে। যানজটে নাকাল আবার তার উপর দেরি হলে বাড়তি বসের ঝাড়ি এবং বেতন কাটা, এগুলো বাড়তি পাওনা। কিন্তু এদেশে অফিস করতে গেলে যে যানজটের কারণে কখন অফিসে ঢুকতে পারবেন, নির্দিষ্ট করে বলা যায়না। এই বিষয়টা সবাই বুঝলেও অফিসের বসেরা বুঝতে চায়না।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: যানজটের ঝামেলাতে বিরক্ত হয়ে অনেকেই সমাধান হিসেবে ফ্রিল্যান্সার পেশাটাকেই এখন পছন্দ করছে। প্রতিদিন রুটিন মেনে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে অফিস করার ঝামেলা মুক্ত থাকা যাচ্ছে। নিজের ঘরটাই তখন অফিস, আবার সেই অফিসে নিজেই বস।

৮) ঘর থেকে বের হলেই অনিশ্চিত জীবন

আপনি যখন চাকুরিজীবী: বর্তমানে রাস্তাতে বের হলেই পরিবারের লোকজন টেনশনে থাকেন ঘরে আবার ফিরতে পারবে তো। প্রতিদিন সকালে অফিসের জন্য যখন বের হয়, তখন থেকেই শুরু হয় এই টেনশন, অফিস থেকে বাসাতে ফিরার আগ পযন্ত এই টেনশন কাজ করে। রোড এক্সিডেন্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক ধরনের অ্যাক্সিডেন্টের ভয় নিয়েই ঘর থেকে বের হতে হয় চাকুরি জীবিদের।

আপনি যখন ফ্রিল্যান্সার: ফ্রিল্যান্সারদের জন্য রাস্তা ঘাটের ঝামেলা মুক্ত জীবন। ঘরে বসেই যদি চাকুরি জীবিদের চাইতে ভাল আয় করা যায়, তাহলে কেন রাস্তাঘাটে বের হওয়ার ঝুকি নিতে হবে? নিজের অন্য অনেক প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু সেটাতো আর প্রতিদিন রুটিন মাফিক টেনশন না। এই রকম আরো অনেক কারণেই চাকুরিজীবি না হয়ে ফ্রিল্যান্সার হওয়া যেতে পারে।

চাকুরি না ফ্রিল্যান্সিং : এক্ষেত্রে চাকুরিজীবি হওয়ার পক্ষেও অনেক যুক্তি রয়েছে

  • চাকুরি করতে গেলে অফিসের অন্যদের থেকে শিখা যায় অনেক কিছু। ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে নিজে নিজে কিংবা নতুন কিছু শিখতে হলে সম্পূর্ণ ভাবে অনলাইনের উপর নির্ভর করতে হয়।
  • চাকুরি জীবিদের জন্য প্রতি মাসের নির্দিষ্ট একটা বেতনের নিশ্চয়তা থাকলেও অনেক সময় নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে সেটা থাকে না।
  • চাকুরি জীবিদের জীবনে যে শৃংখলা থাকে, সময়ানুবর্তিতার চর্চা থাকে ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।
  • এখনও আমাদের সমাজে ফ্রিল্যান্সারদেরকে সেই ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়না, যেমন দেয়া হয় চাকুরি জীবিদের। সেজন্য বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ঝামেলাতে পড়তে হয় ফ্রিল্যান্সারদের।
  • অনেক ফ্রিল্যান্সাররা ঘর কুনো বেশি হওয়ার কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চাকুরি জীবিদের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার সম্ভবনা কম।

চাকুরি না ফ্রিল্যান্সিং এই দুই পেশার ভিতর থেকে, চাকুরিজীবি হবেন নাকি ফ্রিল্যান্সার হবেন সেটি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাল খারাপ দুই দিকই রয়েছে। তবে এখনও আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিংটাকে কেউ পেশা হিসেবে নিতে ভয় পায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক কারণে। তবে খুব শীঘ্র অবশ্যই এর পরিবর্তন আসবে। তখন হয়তো দেখা যাবে, লোকাল অফিস গুলো ফ্রিল্যান্সার হিসেবেই তাদের অফিসের লোক নিয়োগ দিবে। অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবেনা, ঘরে বসেই অফিস করার সুযোগ থাকবে। অনলাইনে যোগাযোগের এই যুগে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসবে।

By arjoda

Leave a Reply

You missed

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ