আমরা সবাই(ঋণ খেলাপিরা ছাড়া!!) জানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা একসময় সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হয়। এই ‘একসময়’ বলতে হতে পারে ঋণ গ্রহণের- এক বছর, দুই বছর বা পাঁচ-দশ বছর। এই সময়ের মাঝে কোন ঋণ গ্রহীতা যদি সুদ-আসল, বা আলাদা করে শুধু সুদ বা আসলের অল্প পরিমাণও ব্যাংককে না দিতে পারে, তখন তার ঋণ খেলাপি(Default) হয়ে যায়। তখন ঐ ঋণ গ্রহীতাকে খেলাপি বা Defaulter বলা হয়।
নন-পারফর্মিং ঋণ কাকে বলে? (Nonperforming Loan – NPL)
যে সমস্ত খেলাপি ঋণ আরেকটি নির্দিষ্ট সময় পার করে সেসকল ঋণকে নন-পারফর্মিং ঋণ বলে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বলতে সাধারণত তিন, ছয় বা নয় মাস বুঝায়।
সাধারণত ‘নন-পারফর্মিং’ ঋণের শ্রেণীকরণ তিন ধরনের করা হয়,
- ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ (তিন মাসের বেশি অনাদায়ি),
- ‘ডাউটফুল’ (ছয় মাসের বেশি অনাদায়ি) এবং
- ‘ব্যাড ডেট বা লস’ (ক্ষেত্র বিশেষে নয় মাস অথবা এক বছরের বেশি সময়ের জন্য অনাদায়ি)। ব্যাড ডেটকে বাংলায় ‘মন্দ ঋণ’ বা কুঋণও বলা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষভাবে ব্যাংক কেন্দ্রিক। বেসরকারি বিনিয়োগ যেমন অনেকাংশে ব্যাংক নির্ভর, তেমনি সরকারি অতি প্রয়োজনীয় ঋণের উৎসও ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর মতে, যদি ৯০ দিনের বেশি সময়ে কোনো ঋণ হিসাবের নির্ধারিত সুদ এবং আসল পরিশোধ করা না হলে তাকে এনপিএল বলে। এটিকে আর্থিক খাতের দূষণও (ঋরহধহপরধষ চড়ষষঁঃরড়হ) বলা হয়।
এনপিএল একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। তবে আন্তর্জাতিক স্তরের তুলনায় বাংলাদেশের এই ঋণ অনুপাত বেশি । বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০,১১,৮২৮ কোটি টাকা । এবং নন-পারফর্মিং ঋণ ছিল ৯৪,৩৩১ কোটি টাকা যা বিতরণ করা ঋণের ৯.৩২%। ২০১৮ সালে এই এনপিএল অনুপাত ছিল ৯.৮৯%। বিশ্ব ব্যাংক এর তথ্য মতে, ২০১৮ সালে এশিয়ান দেশগুলির (২৭টি দেশ) গড় এনপিএল অনুপাত ছিল ৪.৯৯%। সর্বোচ্চ অনুপাত ছিল লেবাননে (১০.২৬%) এবং সর্বনিম্ন হংকংয়ে (০.৫৫%)। বিশ্বব্যাপী গড় এনপিএল ছিল ৬.৮৮%। গড় এনপিএল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়াতে দ্বিতীয় এবং বিশ্বে ২৪তম।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের উচ্চ এনপিএল অন্যতম কারণগুলো হলো: ১) সুশাসনের অভাব ২) ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব ৩) ঋণ আবেদন যথাযথভাবে মূল্যায়নে দুর্বলতা ৪) উপযুক্ত দলিলের অভাব ৫) দুর্নীতি ৬) ঋণ পুনরুদ্ধারে দুর্বল আইনি কাঠামো।
নন-পারফর্মিং ঋণের প্রভাব: নন-পারফর্মিং ঋণ বৃদ্ধি পেলে, একদিকে ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান ক্ষমতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে, আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার মতো পর্যাপ্ত তারল্য ব্যাংকের থাকে না। ফলে আমানতকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাই। ফলস্বরূপ, ব্যাংকের তহবিল খরচও বেড়ে যায় এবং মুনাফা কমে যায়।
কিভাবে নন-পারফর্মিং ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে: ব্যাংকগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে। বোর্ড সদস্যদের নির্বাচন এবং নিয়োগ কঠোর মানদণ্ডের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদা কমিটি করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়নের ক্ষমতা আরও জোরদার করা উচিত। ব্যাংক ঋণ আবেদন অনুমোদনের ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা মূল্যায়নের সাথে ব্যক্তিগত বিষয় যেমন- মালিকের পূর্ব ঋণ পরিশোধের ইতিহাস, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, ব্যবসা পরিচালনা মনোভাব বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো আদালত কর্তৃক খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের স্থগিতাদেশ। বিশেষজ্ঞের মতে, এক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বকেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের পর স্থগিতাদেশ এর জন্য আবেদন করতে পারবে, এমন শর্ত আরোপ করা হলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। এছাড়াও উচ্চ আদালতে একটি ডেডিকেটেড বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে শুধুমাত্র খেলাপি ঋণ মামলা নিষ্কাশনের জন্য।
এমনিতে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নন-পারফর্মিং ঋণের আকার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। করোনা মহামারীতে আরো নতুন নন-পারফর্মিং ঋণ যোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ব্যাংকগুলোর নিজেদের এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর কার্যকরী পদক্ষেপ এর পাশাপাশি বড়ো খেলাপি ঋণধারী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে আমানতকারীদের সচেতন অবস্থান ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অপরিহার্য।
Comments (No)