বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী Jayita Banerjee মাসে আয় 1600 Dollar 1
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী Jayita Banerjee মাসে আয় 1600 Dollar
জয়িতা ব্যানার্জি। ছবি: জুয়েল শীল
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী Jayita Banerjee মাসে আয় 1600 Dollar বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম সেমিস্টারের ফি দিতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন জয়িতা ব্যানার্জি। বাবার অনেক চেষ্টার পর টাকা জোগাড় হয়। তত দিনে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে। গুনতে হয়েছে জরিমানা। ‘আরেক সেমিস্টার আসার আগে নিজেকেই কিছু করতে হবে’—এই তাগিদে আয়ের পথ খোঁজা শুরু করেন তিনি। প্রথমেই টিউশনি। কিন্তু সেই টাকায় অবস্থার তেমন পরিবর্তন হলো না। সেই থেকে আউটসোর্সিংয়ের শুরু করেন জয়িতা। এখন মাসে তাঁর আয় গড়ে ১ হাজার ৬০০ ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী জয়িতা ব্যানার্জি। তাঁর ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প শোনান ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলেপ্রথম আলোরচট্টগ্রাম কার্যালয়ে।

বাবা বিশ্বনাথ ব্যানার্জি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষকের চাকরি করেন, তাঁর আয়ে সংসার চালানোই কঠিন। বাবার ওপর চাপ যেন একটু কমে, সেই আশাতেই টিউশনি শুরু করেছিলেন জয়িতা। প্রথম মাসের আয় দেড় হাজার টাকা, কিন্তু যাতায়াতের পেছনেই চলে যায় একটা বড় অংশ। এমন সময় বন্ধুদের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের খোঁজ পান তিনি।

কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের কিছুই তো জানেন না। শেখার জন্য খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন, আউটসোর্সিংয়ের কোর্স ফি ১১ হাজার টাকা। হাতে তো এক টাকাও নেই। তাই বলে দমে যাননি। বন্ধুদের সহায়তায় নিজেই শিখতে শুরু করেন তিনি।

১ ডলার থেকে ১৬০০ ডলার

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে আউটসোর্সিংয়ের কাজ খোঁজা শুরু হয় জয়িতার। মনোযোগ দেন ইংরেজিতে প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি (কনটেন্ট রাইটিংয়ে) লেখায়। প্রথমে আউটসোর্সিংয়ের বড় ক্ষেত্র (অনলাইন মার্কেটপ্লেস) আপওয়ার্কে ১৮টি প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য চেষ্টা করেন। কেউ কাজ দেয়নি। জয়িতা বলেন, ‘কাজ না পেয়ে হতাশ হলাম। বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আমার কমতি। সেই দুঃখ ভাগাভাগি করে আপওয়ার্ক কমিউনিটিতে একটি পোস্ট করলাম। সেখানে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য আসা শুরু হলো। অনেকে বলল, “ভালো ইংরেজিই তো লিখতে পারো না, কাজ পাবে কীভাবে।” আমার জেদ চেপে গেল।’

এবার জয়িতার শিক্ষক ইউটিউব। ভিডিও দেখে সেগুলো চর্চা করে ইংরেজিতে ভ্রমণকাহিনি লেখা শুরু করলেন। ভালো ইংরেজি জানা বন্ধুদের দেখিয়ে ভুল শুধরে নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পাশাপাশি দুই সপ্তাহ টানা পরিশ্রমের পর আবার নেট দুনিয়ায় ঢুঁ। এর মধ্যে আপওয়ার্কে নিজের প্রোফাইলেও পরিবর্তন এনে লিখলেন, ‘আমি একদম নতুন, আমি কাজ করতে চাই।’ নতুন প্রোফাইলে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ চাইলে তারা জয়িতার সাক্ষাৎকার নিয়ে সন্তুষ্ট হয়। জুটে যায় কাজ। একটি কনটেন্ট লেখার জন্য এক ডলার মজুরি। জয়িতা শুরু করেন। এসব ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। দিনে একটি করে কনটেন্ট লিখতেন। এক সপ্তাহ যাওয়ার পর মজুরি বেড়ে হয় তিন ডলার। এভাবে এপ্রিল মাসে এসে আয় দাঁড়ায় ১০৫ ডলার। নিজের নামে প্রথম ব্যাংক হিসাব খোলেন। জমা হয় ৯ হাজার ২৩২ টাকা। সেখান থেকে ৯ হাজার টাকা জয়িতা তুলে দেন মায়ের হাতে।

কনটেন্ট রাইটিংয়ের পাশাপাশি ডেটা এন্ট্রির কাজও রপ্ত করেন। একসময় ছেড়ে দেন কনটেন্ট রাইটিংয়ের কাজ। মাসে ৬০০ ডলারের চুক্তিতে যুক্ত হন ‘কিউএস আর’ নামের সংগীত প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজও শেখেন। টুকটাক ডিজাইন করে আরও ২০০ ডলার করে আয় শুরু করেন। তবে গ্রাফিকসের কাজ নিয়মিত ছিল না। ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এভাবে চলল। ওই বছরের জুন মাসে যুক্ত হন নিউইয়র্কের একটি স্টার্টআপ রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ‘ট্যাক্সি ল্যান্ড ব্রোকারেজ’–এ। মাসে ৭৫০ ডলারের চুক্তিতে তাদের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজটি তিনি করতেন। এ ছাড়া ‘ফাইভার’–এ অ্যাকাউন্ট করে গ্রাফিক ডিজাইনও নিয়মিত করতে থাকেন। আরও পোক্ত হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্ত হন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘আনাস্তসিয়া বেভারলি হিলস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। পদ ছিল—বিপণন সহকারী। তবে খুব বেশি দিন ছিলেন না সেখানে। এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিউটি ব্র্যান্ড ‘বেলে বার আর্গানিক’–এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে। মজুরি ঘণ্টায় ১৬ ডলার। সপ্তাহের পাঁচ দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে কাজ করেন।

গত জুলাই থেকে খণ্ডকলীন নির্বাহী হিসেবে যোগ দিয়েছেন হসপ্যালস্ নামের হেলথ ট্যুরিজমের প্রতিষ্ঠানেও। এতে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, আউটসোর্সিং ও চাকরি—সময় কীভাবে হয়? জয়িতা মুখে হাসি টেনে বলেন, ‘সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর অফিসে। সেখানে দুই থেকে তিন ঘণ্টার মতো সময় দিতে হয়। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বাসায় ফিরি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে আউটসোর্সিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া বেশির ভাগ ক্লাসেই শেষ করি। এরপরও ছুটির দিনটি কাটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া নিয়ে। গত সেমিস্টারে সিজিপিএ ছিল ২ দশমিক ৯৪।’

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান তৌফিক সাঈদ বলেন, ‘জয়িতার কাছ থেকে অন্যদের অনেক কিছু শেখার আছে। তবে নতুন যারা আসবে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এবং বাড়তি আয় সমানতালে চালাতে হবে।’

হাতখরচের টাকায় ইন্টারনেট

শুরুতে আউটসোর্সিং করতে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে বিপাকে পড়েন জয়িতা। ব্রডব্যান্ডের সংযোগ ছিল না। বাসায় মুঠোফোন কোম্পানির একটি মডেম ছিল। তাতে এক দিনে ১০০ টাকায় এক জিবি ইন্টারনেট পাওয়া যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস থাকলে বাসা থেকে ১০০ টাকা দেওয়া হতো আসা-যাওয়া ও টিফিনের জন্য। চট্টগ্রাম নগরের মুন্সিপুকুর পাড়ের বাসা থেকে হেঁটে দুই কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবর্তক ক্যাম্পাসে আসতেন। কিছু না খেয়ে সেই টাকায় ইন্টারনেটের ডেটা কিনেছেন।

ফ্রিল্যান্সার হতে গেলে

নতুন যাঁরা আউটসোর্সিং করতে চান, তাঁদের জন্য জয়িতার পরামর্শ, দক্ষ না হলে কাজ পাওয়া কঠিন। এ জন্য নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। নতুবা পিছিয়ে পড়তে হবে। কারণ, এখানে সারা বিশ্বের দক্ষ লোকজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। জয়িতা যোগ করেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি বই লিখেছেন—হাবলুদের ফ্রিল্যান্সিং। চলতি বছরের জুলাই মাসে এটি প্রকাশিত হয়। ফ্রিল্যান্সিং লাইভ নামে জয়িতার রয়েছে ইউটিউব চ্যানেলও।

বাবার চাকরিসূত্রে তিন বছর বয়স থেকে চট্টগ্রামে আছেন বরিশালের মেয়ে জয়িতা। কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় বিতার্কিক হিসেবেও নাম হয়েছিল তাঁর। বিতর্ক, ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেয়েছেন ১৬টি পুরস্কার। তবে এসব পুরস্কারের চেয়েও বড় নিশ্চয়ই পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দ।

Leave a Reply

You missed

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ