শখের বশে ইঁদুর পুষে স্বাবলম্বী রাবির মামুন/ Rabir Mamun is self-sufficient and keeps rats as a hobby 2023 ইঁদুরের অত্যাচারে গ্রামগঞ্জ শহরের মানুষ সারা বছর অস্থির থাকে। এদের নিধনে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েও পাওয়া যায় না রেহাই। এমনকি ইঁদুর নিধনে কখনো কখনো পুরস্কারও ঘোষণা করে থাকে কৃষি অফিস। এমন নেতিবাচক অবস্থায় ইঁদুরই কারো ভাগ্য বদলে দিয়েছে শুনলে কিছুটা আশ্চর্য হতে হয়।
শখের বসে বিড়াল, কুকুর পোষে এমন মানুষ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু ইঁদুর পুষে লাভবান হয়েছেন এমন মানুষের কথা হুট করে শুনলে হয়তো বিশ্বাস হবে না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, ইঁদুর চাষ করে লাখ টাকা আয় করছেন প্রতি মাসে।
এমনই একজন মানুষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাব সহকারী সালাউদ্দিন মামুন। প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে শখের বশে ইঁদুর পোষা শুরু করেন তিনি। তবে সেই শখ ধীরে ধীরে বাণিজ্যে পরিণত হবে তা কখনো তিনি ভাবেননি। শখের বসে ইঁদুর পালন করতে গিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সফল মামুন এখন দুটি খামারের মালিক। এছাড়া সারাদেশে তার রয়েছে কয়েকজন খামারী।
সফলতার এই ঘটনার শুরু আজ থেকে ছয় বছর আগে ২০১৭ সালে। ওই বছরের শেষ দিকে ল্যাবের সামনে বসে ছিলেন মামুন। তখন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এক গবেষক মামুনের সহকর্মী মাসুদকে ইঁদুরের চারটি বাচ্চা দিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু তিনি বাচ্চাগুলো বাড়ি নিয়ে আসেন এবং বড় হওয়ার পর ছেড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পালতে থাকেন। বাড়িতে এনে ইঁদুরগুলো তিনি জুতার বাক্সে কাপড় দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। খাবার হিসেবে কিছু চাল, গম দিতেন।
এরই মধ্যে বিড়াল একটি ইঁদুরের বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তিনি বাকি তিনটি বিড়ালের হাত থেকে রক্ষা করতে খাঁচার ব্যবস্থা করেন এবং নিয়মিত খাবারও দিতে থাকেন। মাস খানেক পর একটি ইঁদুর ১০টি বাচ্চা জন্ম দেয়। তার সপ্তাহখানেক পরে আরও একটি ইঁদুর ১০টি বাচ্চা দেয়। ইঁদুরের বাচ্চা দেওয়ার বিষয়টি তিনি বিভাগের সহকর্মীদের জানান।
এ সময় জামার্নির এক গবেষক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। গবেষণার জন্য মামুনের কাছে ইঁদুরগুলো চেয়েছিলেন ওই গবেষক। ইঁদুরগুলো মেরে ফেলার ভয়ে প্রথমে গবেষককে দিতে রাজি হননি প্রাণী প্রেমী মামুন।
পরে মিউজিয়ামের কিউরেটর তাকে বুঝিয়ে বললে তিনি ওই গবেষককে ২০টি ইঁদুর দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে তাকে এক হাজার টাকা দেন ওই গবেষক। টাকা পেয়ে মামুন কিছুটা অবাকই হয়। এরপর থেকেই মূলত ইঁদুর পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি।
অনভিজ্ঞ হওয়ায় ইঁদুর পালনের খুঁটিনাটি বিষয়ে খোঁজও নেন তিনি। ইউটিউব দেখাসহ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের থেকে পরামর্শ নেওয়া শুরু করেন তিনি। সাপ, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে রক্ষা করতে খামার কক্ষের চারদিকে নেট লাগিয়ে দেন। ইঁদুরগুলো ঠাণ্ডা আবহাওয়া ছাড়া থাকতে পারে না। সেজন্য কক্ষে পর্যাপ্ত ফ্যানের ব্যবস্থা করেন। ইঁদুরগুলোকে নিয়মিত চাল, গম, ভুট্টা, ডাল জাতীয় খাবার খাওয়াতে থাকেন।
বর্তমানে তার খামারে ইঁদুরের সংখ্যা কম নয়। দুটি খামারে ইঁদুর আছে প্রায় আটশোর মতো। সুইচ অ্যালবিনো প্রজাতির এই ইঁদুর ৪৫দিন পর পর বাচ্চা প্রসব করে। গবেষণার কাজে ব্যবহৃত ইঁদুরগুলো তিনি একেকটা ১০০ থেকে ১২০টাকা দরে বিক্রি করেন।
করোনাকালে কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য বঙ্গভ্যাক্স এই খামার থেকে ৫০০টি ইঁদুর নিয়েছিল। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামকরা বিভিন্ন ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি এই খামার থেকে ইঁদুর নিচ্ছে।
ব্যতিক্রম উদ্যোগী মামুনের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, সারাদেশে তার দেখাদেখি আরও অনেক খামার গড়ে ওঠেছে। আগে প্রতিমাসে প্রায় লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। কিন্তু খামার বেশি হওয়ায় আগের মতো অর্ডার পাচ্ছি না। আগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গবেষণগার ও প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে ইঁদুর অর্ডার করত।
এখন চট্টগ্রামেই ইঁদুর উৎপাদন করছে খামারিরা। এজন্য তারা আর আমার খামার থেকে ইঁদুর নিচ্ছে না। সারাদেশে প্রায় একই রকম অবস্থা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় বিক্রি কমে গেছে। এখন মাসে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার মতো বিক্রি হচ্ছে।
খামার আরও বড় পরিসরে নেওয়ার ইচ্ছা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইঁদুর চাষে আমি সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। ব্যক্তি উদ্যোগেই শুরু থেকে কাজ করে এখন দুটি খামার করেছি। আমার খামারের ইঁদুরগুলোর চাহিদা বেশি দেশের বাইরে।
আমাদের দেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে রপ্তানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে আরও বৃহৎ পরিসরে আমার ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। সুযোগ থাকলে বিদেশেও রপ্তানি করার ইচ্ছা আছে বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় পশু চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে কোনো পরামর্শ পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত ইঁদুরের কোনো রোগ-বালাই হয় না। ইঁদুরগুলো শীতপ্রধান দেশের জাত হওয়ায় শীতকাল এদের উপযুক্ত ঋতু। আর বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো ডাক্তার আছে বলে আমার জানা নেই। এ রকম কোনো সাপোর্ট আমি পাইনি।
এ খামার থেকে ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করে আসছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবু রেজা। তিনি বলেন, আমরা আগে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঁদুর নিয়ে আসতাম।
গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে মামুনের খামার থেকে নিয়েই গবেষণা করছি। এতে আমাদের খরচ অনেক সাশ্রয় হচ্ছে। খামারের শুরু থেকেই আমি তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তবে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিলে সে খামার থেকে আরও ভালো ফল পেত।