সম্ভাবনার ফ্রিল্যান্সিং সমস্যামুক্ত করুন সম্প্রতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড রিপোর্ট ২০২৩’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের মোট ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ১৪ শতাংশই বাংলাদেশে।
এই প্রতিবেদনের ‘বিশ্ববাণিজ্যের নতুন আকার’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যেও ব্যবসা-বাণিজ্যকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা চলছে। এর জন্য ডিজিটাল মাধ্যমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যে ডিজিটাল মাধ্যম, সেটা আর নতুন করে বলার কোনোই দরকার নেই। দরকার এই মাধ্যমের উন্নয়ন, দক্ষতা অর্জন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহ ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা। আমাদের উপরোক্ত সব কটি উপাদানের ক্ষেত্রেই অনেক ঘাটতি রয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেট প্লেসে কাজ করা হয়।
সেগুলো হিসাব করলে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। কিন্তু মাত্র ১১টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করা হয় আমাদের দেশে। অথচ এক হাজার ২৩টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করার সুযোগ রয়েছে।
ডাব্লিউটিওর প্রতিবেদন থেকেই জানা যাচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানিতে গড়ে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
এর বিপরীতে ডিজিটাল সেবা রপ্তানিতে গড় প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ। ই-কমার্সে ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) উল্লেখ করে ডাব্লিউটিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ৪০০টি প্রতিষ্ঠান ৮০টি দেশে ১৩০ কোটি ডলারের ডিজিটাল সেবা রপ্তানি করেছে। পরের অর্থবছরে ১৬৭টি গন্তব্যে রপ্তানি হয় ১৪০ কোটি ডলারের জিজিটাল সেবা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, কনসালটেন্সি সার্ভিস, নন-কাস্টমাইজ কম্পিউটার সফটওয়্যার, ডাটা প্রসেসিং ও হোস্টিং সার্ভিস, কম্পিউটার মেরামতসহ বিভিন্ন সেবা রপ্তানি চার বছরের ব্যবধানে দেড় গুণের বেশি বেড়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছর ১৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের কম্পিউটারসংক্রান্ত সেবা রপ্তানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এতসব তথ্য-উপাত্ত প্রদানের উদ্দেশ্য হলো এই খাত কতটা সম্ভাবনাময়, তা একনজরে দেখা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম হাতিয়ার হলো্ এই খাত।
বৈদেশিক মুদ্রার এই আকালে এই খাত হয়ে উঠতে পারে এক বড় আশার আলো। সে জন্য এই খাতের দিকে সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন।
আগেই বলা হয়েছে, এক হাজার ২৩টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করার সুযোগ থাকলেও মাত্র ১১টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং হয় আমাদের দেশে। এত বড় জগতের এক ক্ষুদ্র অংশে আমাদের বিচরণ। যদি আমাদের এই জগৎ বড় হয়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের এই খাতটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে দেখুন। এর জন্য দরকার দক্ষতা বাড়ানো। কাজের পরিধি বাড়ানো। সে জন্য দরকার সরকারের বিশেষ দৃষ্টিসহ যাঁরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের এগিয়ে আসা।
উচ্চগতির ইন্টারনেট ছাড়া স্বচ্ছন্দে এই কাজ করা যায় না। সে জন্য ফ্রিল্যান্সারদের বিনা মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় কি না সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ভেবে দেখতে পারে। এটা করা গেলে ফ্রিল্যান্সাররা খুবই উৎসাহিত হবেন। এলাকায় এলাকায় ফ্রিল্যান্সিং জোন করা যেতে পারে। সেখানে প্রশিক্ষণসহ ফ্রিল্যান্সাররা বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। দরকার বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। সরকার যেখানে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করছে, সেখানে ফ্রিল্যান্সারদের প্রণোদনা ৫ শতাংশ করা যেতে পারে।
এ ছাড়া অনেক ফ্রিল্যান্সার তাঁদের প্রাপ্য আয় দেশে আনার ব্যাপারে অনেক সমস্যায় পড়েন। সেদিকে কর্তৃপক্ষের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সুইফটের মাধ্যমে যে পেমেন্ট আসে, তা তাঁদের হিসাবে জমা হতে অনেক সময় লেগে যায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ব্যাংক থেকে যোগাযোগ করাসহ ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও কয়েক দিন লেগে যায় বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন। এই প্রক্রিয়া সহজতর ও দ্রুততর করার পদ্ধতি বের করতে হবে। ফ্রিল্যান্সাররা এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে পেপাল সিস্টেমের কথা বলে থাকেন।
কিন্তু নানা রকম জটিলতায় এই পদ্ধতি সরকার অনুমোদন দিচ্ছে না। প্রয়োজনে এই পদ্ধতির নেতিবাচক বিষয়গুলো এড়িয়ে কিভাবে নিশ্চিত নিরাপত্তা রক্ষা করে ফ্রিল্যান্সার ও দেশের স্বার্থ সুরক্ষা করা যায় তার পদ্ধতি উদঘাটন করতে হবে। ফ্রিল্যান্সাররা প্রায়ই ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের অ্যাওয়ার্ড পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী এর ওপর ১০ শতাংশ আয়কর নির্ধারণ করা রয়েছে।
বিকাশমান এই খাতের স্বার্থে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই ১০ শতাংশ আয়কর রেয়াত দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে।
ফ্রিল্যান্সাররা অর্থনীতির নীরব সৈনিক। তাঁরা নীরবে, পেছনে থেকে, রাত জেগে, অনেক পরিশ্রম করে সচল রেখেছেন এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের চাকা। এই চাকার গতি দ্রুততর করতে হলে, এই চাকা আরো বড় করতে হলে তাঁদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে যৌক্তিকভাবে, মমতায়। তাহলে তাঁরা নির্ভরতা পাবেন। সৈনিক থেকে বীরে পরিণত হবেন। তাঁরা যেমন তাতে এগিয়ে যাবেন, দেশও এগিয়ে যাবে।
Comments (No)