লাউ আমাদের দেশে একটি অন্যতম সুস্বাদু সবজি। লাউ সব ধরণের মাটিতে জন্মে। সাধারণত লাউ শীতকালে চাষ করা হয়ে থাকে। লাউয়ের পাতা নরম ও সবুজ বিধায় পাতা ও ডগা শাক হিসাবে এবং লাউ ভাজি ও তরকারী রান্না করে খাওয়া হয়। লাউয়ের চেয়ে এর শাক পুষ্টিকর বেশি।
লাউ লতানো উদ্ভিদ তাই সারা বছরই চারা লাগিয় চাষ করা যায়। লাউ বীজ রোপণ করার আগে খেয়াল করে দেখে নিতে হবে আপনার এলাকায় কোন লাউ, লম্বা না গোল লাউ চাহিদা বেশি? যে লাউয়ের চাহিদা বেশি সেই লাউ চাষ করতে হবে। নিচে লাউ চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
লাউয়ের চারা উৎপাদন, বীজতলা তৈরি ও বীজ বপণ
লাউ চাষের জন্য পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিলে ভালো হয়। স্বাভাবিকভাবে আলো বাতাস থাকে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। বেড ২০-২৫ সেমি উঁচু করতে হবে।
বীজ বপনের জন্য ৮*১০ সেমি আকারের পলিব্যাগ দরকার। অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে বা এক তৃতীয়াংশ কম্পেষ্ট সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। বীজ গজানোর জন্য মাটির জো ঠিক রাখতে হবে। মাটিতে জো না থাকলে পানি দিয়ে জো করে নিয়ে পলিব্যাগ ভরতে হবে।
বীজের সহজ অংকুরোদগম
লাউয়ের বীজের খোসা কিছুটা শক্ত বধিায় অংকুরোদগম হতে সময় লাগে। সহজে অংকুরোদগমের জন্য পরিস্কার পানিতে ১৫-২০ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে অথবা শতকরা ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে একরাত ভিজিয়ে তারপর পলিব্যাগে বীজ বপন হবে।
বীজতলায় চারার পরিচর্যা
চারা অংকুরোদগম হওয়ার পর বেডে চারার সঠিক ভাবে পরিচর্যা করতে হবে। শীতের সময় চারা গজাতে সমস্যা হয়। এজন্য শীতের সময় বীজ গজানোর আগে প্রতি দিন রাতে বেড ঢেকে রাখতে হবে। এবং দিনের বেলাতে খোলা রাখতে হবে। বেডে চারার চাহিদা অনুসারে পানি দিতে হবে।চারার গায়ে পানি না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পানি দেওয়ার ফলে পলিব্যাগের মাটি চটা বাধলে চটা ভেঙে দিতে হবে।
মূল জমি তৈরি ও চারা রোপন, জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি
মাটি : জৈব পদার্থ এঁটেল দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য ভাল হয়।
জলবায়ু: আমাদের দেশে লাউ চাষের জন্য উপযোগী মৌসুম হলো শীতকাল। বেশি গরমও না
আবার বেশি শীতও না এমন আবহাওয়া লাউ চাষের জন্য ভাল।
বীজ গজানোর পর চারার বয়স যখন ১৬-১৭ দিন হবে তখন চারা মাঠে লাগানো উত্তম।
মাদা তৈরি এবং বেডে মাদা হতে মাদার দুরত্ব:
অবশ্যই মাদার মাটি ঢলো চুন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে, মাদা প্রতি ১০০ গ্রাম
মাদা দূরত্ব মাদা থেকে মাদা ৬,হাত বাই ৭ হাত
মাদা গর্ত ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ দিগ ১ হাত বাই ১ হাত
সার প্রয়োগ
যতটা পারেন গর্তে পচা গোবর, কচুরিপানা দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিবেন ৭দিন। প্রতি মাদায়, সার
টি,এস,পি ১০০ গ্রাম, খইল ১০০ গ্রাম, পটাশ ৫০ গ্রাম, বোরন ২০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম।
মাদায় দিয়ে মাটি ভালো করে উলট পালট করে দিবেন, ৮-১০ দিন, পর বীজ অথবা চারা লাগানো যাবে।
চারার পরিচর্যা, সঠিক সময়ে সেচ দেয়া
লাউ গাছের প্রচুর পরিমানে পানি প্রয়োজন হয়। লাউ গাছের প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয় এবং ফল আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে। ভালো ফলন পাওয়ার জন্য নালার মাধ্যমে গাছের প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। নালায় পানি দিয়ে জমিয়ে রাখলে গাছ তার প্রয়োজন মতো পানি টেনে নিবে। শুষ্ক মৌসুমে লাউ গাছে ৪-৫ দিন পরপর সেচ দিতে হয়।
মালচিং ও বাউনি দেয়া
মালচ অর্থ মাটি ঢেকে দেওয়া, আর মালচিং হলো মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা। মাটির রস ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের বস্তু দিয়ে গাছের গোড়া, সবজি ক্ষেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে।
লাউ গাছ স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জন্য বাঁশ/রশি দিয়ে বাউনীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
আগাছা দমন
লাউয়ের চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত সব সময় জমির আগাছা পরিস্কার করে রাখতে হবে। লাউ গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্য প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে ও গাছের গোড়ার রস চুষে নেয়। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ঘাসের কারণে লাউয়ে বোটল গোর্ড মোজাইক ভাইরাস নামের রোগ হয়ে থাকে। তাই ভালো ফলনের জন্য আগাছা পরিস্কার করে রাখতে হবে।
লাউ গাছের পরিচর্যা, লাউ গাছের শোষক শাখা অপসারণ
লাউ গাছের গোড়ার দিকে যে ছোট ছোট ডগা বের হয় সে গুলোকে শোষক শাখা বলে। এসকল শাখা গুলো গাছের ফলন ও গাছ বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাড়ায়। গাছের গোড়ার দিকের ৪০-৪৫ সে.মি. পর্যন্ত সবগুলো শোষক শাখা কেটে ফেলতে হবে।
ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন
লাউয়ের ফলন বৃদ্ধির জন্য হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করে ৩০-৩৫% ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়নের সঠিক সময় হলো দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাণিজ্যিক ভাবে লাউ চাষ করলে হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করা সম্ভব হয় না তাই, প্রতি হেক্টরে ২-৩ টি মৌমাছির কলোনী স্থাপন করে কৃত্রিম পরাগায়ন করা সম্ভব।
ফলন ও ফসল তোলা
সঠিক ভাবে যত্ন নিয়ে লাউ চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৩৫-৪০ টন এবং প্রতি বিঘায় ৪.৫-৫টন ফলন পাওয়া যায় এবং সেই সাথে প্রতি হেক্টরে ৫০০ কেজি পর্যন্ত বীজও উৎপাদন করা যায়।
লাউয়ের পরিপক্কতা সনাক্তকরণ করার উপায়-
পরিপক্ক লাউয়ের গায়ে প্রচুর শুং থাকবে।
লাউয়ের গায়ে নখ দিয়ে হালকা চাপ দিলে খুব সহজেই নখ ডেবে যাবে।
লাউয়ের পরাগায়নের ১২-১৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
রোগবালাই ও ক্ষতিকর পোকামাকড় দমণ
মোজাইক প্রতিকার: যে সকল গাছ আক্রান্ত হবে সে গাছ গুলো প্রথম দিকেই তুলে ধ্বংস করতে হবে। জমির আগাছা পরিস্কার করে রাখতে হবে।
মাছি পোকা
মাছি পোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফেরমেন ফাদ টানিয়ে দিতে হবে।
পাতা ছিদ্রকারি পোকা
পাতা ছিদ্রকারি পোকার হাত বাচাতে হবে। সে জন্য সাইফারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে,
পাতা কুকরে যাওয়া রোগ
লাউগাছের পাতা কুকরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ভার্টিমেক, এর সাথে কনফিডর, অথবা টিডু প্লাস, অথবা একতারা, মিক্স করে স্প্রে করে দিতে হবে।
পাতা লাল হয়ে যায়, কড়া পচে যায়?
পাতা লাল হয়ে যায়, কড়া পচে যায়ওয়ার হাতথেকে রক্ষা পাবার জন্য ফেরমেন ফাদ টানিয়ে দিতে হবে।
এছাড়া ছত্রাক নাশকের জন্য রিডুমিল গুল্ড, অথবা ক্যাবরিয় টপ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে স্প্রে করতে হবে, ভিটামি গাছের গ্রুথ দেখে, ফ্লোরা, বায়োগ্রিন, লিটুসেন, দিতে পারেন।
তবে লাউ গাছে খাদ্যের অভাব যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে।
Comments (No)