যেভাবে ছাগল পালন করেই হবেন লাভবান

ছাগল সাধারনত গরিভের গাভী বলে উপাধি দেয়া হয়ে থাকে এবং কম পূজিঁর ব্যবসায় এটি বর্তমানে অধিক লাভজনক একটি ব্যবসা। বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ পশুসম্পদ। ছাগল আমাদের দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য হ্রাস মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ছাগল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য যে এদেশের মোট প্রায় আড়াই কোটি ছাগলের অধিকাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের।

যেভাবে ছাগল পালন করেই হবেন লাভবান 1

ছাগল পালনের সুবিধাদিঃ
* ছোট প্রাণীর খোরাক তুলনামূলকভাবে অনেক কম, পালনের জন্য অল্প জায়গা লাগে এবং মূলধনও সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে।
* গবাদিপশুর তুলনায় ছাগলের রোগবালাই কম।
* তুলনামূলক কম সময়ে অধিক সংখ্যক বাচ্চা পাওয়া যায়। বছরে দুইবার বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রতিবারে গড়ে ২-৩ টি বাচ্চা হয়ে থাকে।
* দেশে ও বিদেশে ব্ল্যাক ছাগলের চামড়া, মাংস ও দুধের বিপুল চাহিদা আছে।
* ছাগলের দুধ যক্ষ্মা ও হাঁপানি রোগ প্রতিরোধক হিসাবে জনশ্রুতি রয়েছে এবং এজন্য এদের দুধের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
* ছাগল ভূমিহীন ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষীদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যঃ
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বক্ষস্থল চওড়া, কান কিছুটা উপরের দিকে ও শিং ছোট থেকে মাঝারী আকৃতির হয়ে থাকে। দেহের গড়ন আটসাট পা অপেক্ষাকৃত খাটো ও এবং লোম মসৃন হয়।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের সুবিধাঃ
সাধারণতঃ ১২-১৫ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়। একটি ছাগী বছরে দুইবার বাচ্চা প্রসব করলেও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ছাগী ২-৮ টি পর্যন্ত বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে। ২০ কেজি দৈহিক ওজন সম্পন্ন একটি ছাসী থেকে কমপক্ষে ১১ কেজি খাওয়ার যোগ্য মাংস এবং ১.-১.৪ কেজি ওজনের অতি উন্নতমানের চামড়া পাওয়া যায়। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া একটি অতি মূল্যবান উপজাত। দেখা গেছে, সেমি-ইন্টেনসিভ পদ্ধতিতে ২৫টি ছাগীর খামার থেকে ১ম বছরে ৫০,০০০ টাকা, ২য় বছরে ৭৫,৩৩৭ এবং ৩য় বছরে ১,০২,৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব (সূত্রঃ ছাগল পালন ম্যানুয়েল)।

ছাগল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য গুণাবলীঃ
পাঠাঁর ক্ষেত্রেঃ
* পাঠাঁর বয়স ১২ মাসের মধ্যে হতে হবে, অন্ডকোষের আকার বড় এবং সুগঠিত হতে হবে।
* পিছনের পা সুঠাম ও শক্তিশালী হতে হবে।
* পাঠাঁর মা, দাদী বা নানীর বিস্তারিত তথ্যাদি (অর্থাৎ তারা বছরে ২ বার বাচ্চা দিত কীনা, প্রতিবারে একটির বেশি বাচ্চা হতো কীনা, দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ইত্যাদি গুণাবলী) সন্তোষজনক বিবেচিত হলেই ক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
ছাগীর ক্ষেত্রেঃ
* নির্বাচিত ছাগী হবে অধিক উৎপাদনশীল বংশের ও আকারে বড়।
* নয় বা বার মাস বয়সের ছাগী (গর্ভবতী হলেও কোনো সমস্যা নেই) কিনতে হবে।
* ছাগীর পেট তুলনামূলকভাবে বড়, পাজরের হাড়, চওড়া, প্রসারিত ও দুই হাড়ের মাঝখানে কমপক্ষে এক আঙ্গুল ফাঁকা জায়গা থাকতে হবে।
* নির্বাচিত ছাগীর ওলান সুগঠিত ও বাঁট সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

বয়স নির্ণয়ঃ
ছাগলের দাঁত দেখে বয়স নির্ধারণ করতে হয়। বয়স ১২ মাসের নিচে হলে দুধের সবগুলোর দাঁত থাকবে, ১২-১৫ মাসের নিচে বয়স হলে স্থায়ী দাঁত এবং ৩৭ মাসের ঊর্ধ্বে বয়স হলে ৪ জোড়া স্থায়ী দাঁত থাকবে।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়াদিঃ
গ্রহণযোগ্য ছাগল অবশ্যই সকল ধরনের সংক্রামক ব্যাধি, চর্মরোগ, চক্ষুরোগ, যৌনরোগ ও বংশগত রোগমুক্ত হতে হবে। পিপিআর খুবই মারাত্মক রোগ বিধায় কোনো এলাকা থেকে ছাগল সংগ্রহ করার আগে উক্ত এলাকায় পিপিআর রোগ ছিল কীনা তা জানতে হবে। উক্ত এলাকা কমপক্ষে ৪ মাস আগে থেকে পিপিআর মুক্ত থাকলে তবেই সেখান থেকে ছাগল সংগ্রহ করা যেতে পারে।

ছাগল ক্রয়ঃ
সাধারণত যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চল, ময়মনসিংহের ত্রিশাল, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বগুড়ার ধুনট, ফরিদপুর, মেহেরপুর ও কয়েকটি স্থানে উন্নতমানের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পাওয়া যায়। এসব স্থান থেকে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ছাগল ক্রয় করা যেতে পারে।

বাছাইকৃত ছাগলের পরিবহন ব্যবস্থাঃ
নির্বাচিত ছাগলকে পূর্বে পিপিআর ভ্যাকসিন দেয়া না থাকলে পরিবহনের ২১ দিন পূর্বে পিপিআর ভ্যাকসিন দিতে হবে। পরিবহনের পূর্বে ছাগলকে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ ও চিটাগুড় মিশ্রিত পানি (পানি ১ লিটার, লবণ ১০ গ্রাম ও চিটাগুড় ৩০ গ্রাম) খাওয়াতে হবে। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা কিংবা ঝড়-বৃষ্টিতে এদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করা মোটেও উচিত নয়।

যেভাবে ছাগল পালন করেই হবেন লাভবান 2

জৈব নিরাপত্তাঃ
খামার এলাকার বেড়া বা নিরাপত্তা বেস্টনী এমনভাবে নির্মান করতে হবে যাতে সেখানে অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি, শেয়াল-কুকুর ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশপথে ফুটবাথ বা পা ধোয়ার জন্য ছোট চৌবাচ্চায় জীবাণুনাশক মেশানো পানি রাখতে হবে। খামারে প্রবেশের আগে খামারে গমনকারী তার জুতা/পা ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করবেন। খামারের জন্য সংগৃহীত নতুন ছাগল সরাসরি খামারে পূর্বে বিদ্যমান ছাগলের সাথে রাখা যাবে না। নূতন আনীত ছাগলদেরকে স্বতন্ত্র ঘরে সাময়িকভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের ঘরকে পৃথকীকরণ ঘর বা আইসোলেশন শেড বলে। অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহ এই শেডে রাখা বিশেষ জরুরি। এসব ছাগলের জন্য প্রাথমিক কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে এদেরকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। এজন্য বহিঃপরজীবী এবং আন্তঃ পরজীবীর জন্য কার্যকর কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। চর্মরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ছাগলকে (০.৫%) শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ম্যালাথিয়ন দ্রবণে গোসল করাতে হবে। আইসোলেশন শেডে ছাগল রাখার পর ১৫ দিনের মধ্যে যদি কোনো রোগ না দেখা দেয় তাহলে প্রথমে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন এবং সাত দিন পর গোটপক্সের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। শেষ টিকা প্রদানের সাত দিন পর এসব ছাগলকে মূল খামারে নেয়া যেতে পারে। প্রতিদিন সকাল এবং বিকালে ছাগলের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। কোনো ছাগল যদি অসুস্থ হয় তাহলে তাকে আলাদা করে আইসোলেশন শেডে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো ছাগল মারা যায় তবে অবশ্যই তার কারণ সনাক্ত করতে হবে। ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের পর তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বিশেষ করে অন্যান্য ছাগলের অন্য নিতে হবে। মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে নিয়ে মাটির গভীরে পুতে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলের ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি ও দ্রব্যাদি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

ছাগলের বাসগৃহঃ
ছাগলের ঘর শুষ্ক, উচুঁ, পানি জমে না এমন স্থানে স্থাপন করা উচিত। পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি, দক্ষিণ দিক খোলা এমন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাঠাঁল, ইপিল ইপিল, কাসাভা ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের জন্য উত্তম ব্যবস্থা আছে এমন স্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ছাগল ঠাসাঠাসি অবস্থায় বাস করতে পছন্দ করে না। এরা মুক্ত আলো বাতাস এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে থাকতে পছন্দ করে। এক জোড়া ছাগলের জন্য ৫ ফুট লম্বা, ১.৫ ফুট চওড়া এবং ৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট খোয়াঁড় প্রয়োজন। প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক ছাগলের জন্য গড়ে ১০-১৪ বঃ ফুট এবং বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য ৩-৮ বঃ ফুট জায়গা প্রয়োজন। ছাগলের ঘর ছন, গোলপাতা, খড়, টিন বা ইট নির্মিত হতে পারে। তবে ঘরের ভিতর বাঁশ বা কাঠের মাচা প্রস্তুত করে তার উপর ছাগল রাখা উচিত। মাচার উচ্চতা ১ মিটার (৩.৩৩ ফুট) এবং মাচা থেকে ছাদের উচ্চতা ৬-৮ ফুট হবে। মল-মূত্র নিষ্কাষনের গোবর ও চনা সুবিধার্থে বাঁশের চটা বা কাঠের মাঝে ১সেঃ মিঃ ফাক লাখতে হবে। মেঝে মাটির হলে সেখানে পর্যাপ্ত বালি দিতে হবে। বৃষ্টি যেন সরাসরি ঘরের ভিতর প্রবেশ না করতে পারে সে জন্য ছাগলের ঘরের চালা ১-১.৫ মিঃ (৩-৩.৫ ফুট)
ঝুলিয়ে দেয়া প্রয়োজন। শীতকালে রাতের বেলায় মাচার উপরের দেয়ালকে চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পাঠাঁর জন্য অনুরূপভাবে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ও মল-মূত্র নিষ্কাষনের উত্তম সুবিধাযুক্ত পৃথক খোয়াড় তৈরি করতে হবে। শীতকালে মাচার উপর ১.৫ ইঞ্চি পুরু খড় বিছিয়ে তার উপর ছাগল রাখতে হবে। প্রতিদিন ভালোভাবে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকিয়ে পুনরায় বিছাতে হবে।

ছাগলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাঃ
একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে মুক্তভাবে ছাগল প্রতিপালনের তুলনায় আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন অনেক বেশি ঝুকিপূর্ণ। এ ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা ও প্রযুক্তির সমন্নয় না ঘটালে খামারীকে বিস্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা একটি বাস্তব উপলদ্ধি। এজন্য ছাগলের সুখ-সাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থ্যর প্রতি খামারীকে স্বতন্ত্র ভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ছাগলের খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন রোগ দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে খামার থেকে লাভের আশা করা যায় না। খামারে ছাগল আনার পর থেকে প্রতিদিনই প্রতিটা ছাগলের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথম পাঁচ দিন সকাল ও বিকালে দুবার থার্মোমিটার দিয়ে ছাগলের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কোনো রোগ দেখা মাত্রই পশু চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় ছাগী বা বাচ্চাদের গায়ে চট পেঁচিয়ে দেয়া যেতে পারে। মাচার নিচ এবং ঘর প্রতিদিন সকালে পরিষ্কার করতে হবে এবং কর্মসূচি অনুযায়ী জীবাণুনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুস্থ ছাগলের বৈশিষ্ট্যঃ
সুস্থ ছাগলের নাড়ীর স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০-৯০ বার, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতি মিনিটে ২৫-৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫ সেঃ হওয়া উচিত। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ থাকবে পরিষ্কার, চামড়া নরম, পশম মসৃন ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিচ্ছন্ন।
ছাগল সুস্থ রাখতে যেসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক সেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

কর্মসূচি অনুযায়ী টিকা প্রদানঃ
ভাইরাসজনিত রোগ যেমন পিপিআর, গোটপক্স, ক্ষুরারোগ ইত্যাদি এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যেমন এনথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি খুবই মারাত্মক বলে এগুলোর বিরুদ্ধে যথারীতি টিকা প্রদান করতে হবে। যেসব ছাগীকে পূর্বে পিপিআর, গোটপক্স, একথাইমা, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি টিকা দেয়া হয়নি তাদেরকে গর্ভের ৫ম মাসে উক্ত ভ্যাকসিনগুলি দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৫ মাস তখন তাকে পিপিআর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিতে হবে।

কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগঃ
সকল ছাগলকে নির্ধারিত মাত্রায় বছরে দুইবার কৃমিনাশক ঔষধ প্রদান করতে হবে। কৃমিনাশক কর্মসূচি অনুসরণের জন্য পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
ছাগলকে রাস্তার ধার, পুকুর পাড়, জমির আইল, পতিত জমি বা পাহাড়ের ঢালে বেঁধে বা ছেড়ে ৮-৯ ঘন্টা ঘাস খাওয়াতে পারলে খুব উপকার হবে। এ ধরনের সুযোগ না থাকলে প্রতি ২০ কেজি ওজনের ছাগলের জন্য দৈনিক ০.৫-১ কেজি পরিমাণ কাঠাঁল, ইপিল ইপিল, ঝিকা, বাবলা পাতা অথবা এদের মিশ্রণ দেয়া যেতে পারে। প্রতিটি ছাগলকে দৈনিক ২৫০-৩০০ গ্রাম ঘরে প্রস্তুতকৃত দানাদার খাদ্য দেয়া যেতে পারে। ১০ কেজি দানাদার খাদ্য মিশ্রণে যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন তা হচ্ছেঃ চাল ভাঙ্গা ৪ কেজি, ঢেঁকি ছাঁটা চালের কুড়া ৫ কেজি, খেসারি বা অন্য কোনো ডালের ভূষি ৫০০ গ্রাম, ঝিনুকের গুড়া ২০০ গ্রাম এবং লবণ ৩০০ গ্রাম। ইউরিয়া দ্বারা প্রক্রিয়াজাত খড় ও সাইলেজ খাওয়ালে ভাল হয়। কারণ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে এবং পরিপাকও ভালোভাবে হয়। জন্মের পর থেকেই ছাগল ছানাকে আঁশ জাতীয় খাদ্য যেমন কাঁচা ঘাস ইত্যাদিতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। দানাদার খাদ্য খাওয়ানোর পর ছাগলকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিষ্কার পানি খেতে দিতে হবে। বাড়ন্ত ছাগলকে দৈনিক প্রায় ১ লিটারের মতো পানি পান করা উচিত। কাঁচাঘাস কম বা এর অভাব ঘটলে ছাগলকে ইউরিয়া-চিটাগুড় মেশানো খড় নিম্নোক্ত প্রণালীতে বানিয়ে খাওয়াতে হবে।

উপকরণঃ
২-৩ ইঞ্চি মাপের কাটা খড় ১ কেজি, চিটাগুড় ২২০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩০ গ্রাম ও পানি ৬০০ গ্রাম। এবারে পানিতে ইউরিয়া গুলে তাতে চিটাগুড় দিয়ে খড়ের সাথে মিশিয়ে সরাসরি ছাগলকে দিতে হবে। খাসীর ক্ষেত্রে তিন-চার মাস বয়সে দুধ ছাড়ানোর পর নিয়মিত সঠিকভাবে এই প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাওয়ালে দৈনিক ৬০ গ্রাম করে দৈহিক ওজন বাড়ে ও এক বছরের মধ্যে ১৮-২২ কেজি ওজন প্রাপ্ত হয়ে থাকে। খাসীকে দৈহিক ওজনের উপর ভিত্তি করে মোট ওজনের ৭% পর্যন্ত পাতা বা ঘাস জাতীয় খাদ্য দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ (চাল ভাঙ্গা ৪০%, কুড়া ৫০%, ডালের ভূষি ৫৫, লবণ ৩% এবং ঝিনুকের গুড়া ২%) ১০০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ গ্রাম ও ভাতের মাড় ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত খেতে দেয়া যেতে পারে। খাসীর ওজন ২০ কেজির বেশি হয়ে গেলে এদের দেহে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই এ সময়েই এদেরকে বাজারজাত করা উচিত। ছাগল খামারের খাদ্য খরচ মোট খরচের ৬০-৭০% হওয়া আবশ্যক। বাণিজ্যিক খামারের লাভ-লোকসান তাই খাদ্য ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। নিম্নে বাণিজ্যিকভাবে পালিত ছাগলের দানাদার খাদ্যের সাধারণ মিশ্রণ প্রদত্ত হলঃ

অন্যান্য ব্যবস্থাপনাঃ
সঠিক অনুপাতে (১০ টি ছাগীর জন্য ১টি পাঠাঁ) ছাগী ও পাঠাঁ পালন করতে হবে। পাঠাঁ এবং ছাগীকে কখনও একত্রে খাদ্য খেতে ও মাঠে চরানো যাবে না, কারণ পাঠাঁ ছাগীকে খাদ্য খেতে অসুবিধার সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় মারামারি করে ক্ষতের সৃষ্টি করে থাকে। প্রজননক্ষম পাঠাঁ ছাগীকে নিয়মিত (বছরে ৫-৬ বার) ০.৫% মেলাথিয়ন দ্রবণে চুবিয়ে বহিঃপরজীবী থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বাচ্চার ক্ষেত্রে যাতে উক্ত দ্রবণ নাকে বা কানে যেন প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। (গর্ভের ১ম মাসে ১-১.৫ মিলি ভিটামিন এ.ডি.ই এবং গর্ভের শেষ দুই সপ্তাহে ১-১.৫ মিলি ৪৮ ঘন্টা পরপর ইনজেকশন দিতে হবে)। প্রসবের লক্ষণ দেখা দিলে ছাগীর পিছনের অংশ ও ওলান পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এর ০.৫-১% দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে মুছে দিতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পর জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল চাকু বা ব্লেড দ্বারা নাভি ২-৩ সেঃমিঃ রেখে বাকি অংশ কেটে দিতে হবে। (এ সময় ছাগীর জরায়ুতে যাতে ইনফেকশন না হয় সেজন্য পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গনেট দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং এরপর ক্যাপলেট (মাত্রাঃ১ ক্যাপলেট/১০-২০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য) অথবা বোলাস (মাত্রাঃ ১-২ বোলাস) জরায়ুতে দিতে হবে)। প্রসবের ২৪ ঘন্টা পরও ফুল বা প্লাসেন্টা না পড়লে অক্সিটোসিন (মাত্রাঃ ১-২ মিলি/ ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য) ইনজেকশন দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৩-৫ সপ্তাহ তখন শিং ওঠা বন্ধ করা উচিত। বাচ্চা বয়স ২-৪ সপ্তাহ হলে তাকে খাসী করানো উচিত।
খাসী করতে হলে টেবিল বা এ জাতীয় উচু জায়গায় রেখে পিছনের পা দুটো টেনে সামনে নিয়ে আসতে হবে। এরপর অন্ডকোষকে ৩% টিংচার দ্রবণ দিয়ে ভাল করে মুছে দিতে হবে। অন্ডকাষকে চামড়ার বিপরীতে চেপে ধরে চামড়ার নিচের দিকে একটি মাত্র পোচে কেটে অন্ডকোষ দুইটি বের করে রগ (Spermatic cord) কেটে দিতে হবে। এরপর অন্ডকোষ থলিকে টিংচার অব আয়োডিন দ্বারা পরিষ্কার করে ক্ষতস্থানে পাউডার লাগিয়ে দিতে হবে।

Comments (No)

Leave a Reply

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ