মজুরি বোর্ড ছয় মাসের মধ্যে শ্রমিকদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে, এই বেতন কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, শ্রমিকদের বেতন বাড়লে কত নির্ধারন করবে?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসেবে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মূলত তিনটি মডেলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রথম মডেলটি হচ্ছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানকারী একজন শ্রমিকের মাসিক খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। দ্বিতীয় মডেলটি হলো, কাঙ্ক্ষিত পুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে সুষম খাবার, তা বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। তৃতীয় মডেলটি হলো, শ্রমিকদের বর্তমান জীবনধারণের খরচের হিসাব বিবেচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা।
সিপিডি বলেছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা। সিপিডির হিসেবে পরবর্তী দু’টি মডেলে এই পরিমাণ আরও বাড়ে। কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। প্রকৃত খরচ অনুযায়ী বিবাহিত একজন শ্রমিকের মাসে আয় করতে হবে ১০ হাজার ৩৫২ টাকা।
উল্লেখ্য, পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ গত ২০১৩ সালের নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণার এক মাস পর ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। সে অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলে বর্তমানে একজন শ্রমিক ন্যূনতম পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। এ ছাড়া বছরে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা আছে। দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা করা যায়। এ ছাড়া বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় যেকোনও পর্যায়ে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার নিয়ম আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ৫ বছরের আগেই সরকার স্বেচ্ছায় মজুরি বোর্ড গঠন করলো সরকার।
সরকারের একটি স্থায়ী ন্যূনতম মজুরি বোর্ড রয়েছে। চার সদস্যের সেই বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। এই বোর্ডের অন্য তিন সদস্য হলেন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ এমপ্লায়ার্স ফেডারেশনের শ্রম উপদেষ্টা কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু, নিরপেক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন। রবিবার পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গঠিত স্থায়ী মজুরি বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার বেগম।
নতুন মজুরি বোর্ড প্রসঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কমিটি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন কাঠামো যাচাই-বাছাই করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে। এরপর সরকার পোশাক শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বোর্ড বসেই ঠিক করবে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জন্য আমরাই সরকারকে বোর্ড গঠনে চিঠি দিয়েছি। তাই শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে এ নিয়ে তো কোনও দ্বিধা নেই। সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই নতুন বেতন কাঠামো সুপারিশ করা হবে। এ মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলা যাবে না।’
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে গত ৮ নভেম্বর তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পোশাক খাতের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়। বিজিএমইএ-এর এই উদ্যোগকে সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বলে মন্তব্য করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাভারের এ আর গার্মেন্টস-এর শ্রমিক শাহানাজ খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চলে না। পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা বেতনে কি আর সংসার চলে? বর্তমান বাজারে ঘরভাড়া পরিশোধে চলে যায় বেতনের অর্ধেক। বাকি টাকা দিয়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরের চাল কিনে সংসার চালানো যে কত কঠিন, তা বলে বোঝানো যাবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মালিকরা সব সময় বেতনের সঙ্গে ওভার টাইম ধরে বেতন বোঝান। ওভার টাইম তো বেতন নয়। এছাড়া ওভার টাইম তো সবার পক্ষে করাও সম্ভব নয়। ওভার টাইম কেউ কেউ করেন, সবাই করেন না। যদি একজন শ্রমিক ওভার টাইম না করেন, তাহলে তো তিনি ওভার টাইমের বিল পাবেন না। তাহলে তার সংসার চলবে কিভাবে?’ বর্তমান বাজারে ন্যূনতম বেতন হওয়া প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা বলেও তিনি মনে করেন।
এদিকে রাজধানীর অদুরে আশুলিয়ায় অবস্থিত গার্মেন্টস মালিক সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকরা আমাদের পরিবারের সদস্য। তারা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে বেতন বাড়ানো উচিত। এটা সময়ের দাবি। মালিকদের বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্যও।’
এদিকে দেশের অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ তুলেছেন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবনধারণকেই কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের ভবিষ্যৎ জীবন, সঞ্চয়, সন্তানদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখা হয় না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেছেন, ‘‘বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনও কোম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন এবং ১০ শতাংশ কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তৈরি পোশাক কারখানায় এর কিছুই মানা হয় না। এটা অনেক পুরনো আইন। ‘বিলস্’-এর অর্থায়নে ২০০৯ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছিলাম, মালিকরা যদি তাদের অর্জিত মুনাফার মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দিতেন তাহলেই প্রতি বছর সেখানে ৩০০ কোটি টাকা জমা হতো। এ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য নতুন নতুন বাসস্থানসহ নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া যেতো। অনেক সমস্যার সমাধান হতো। কিন্তু তারা সমাধান চান না। তারা চান শুধু মুনাফা।’’
উল্লেখ্য, দেশে এর আগে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর। তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছিল তখন। নতুন কাঠামোয় ওই বেতন তারা পাচ্ছেন ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে। যা অব্যাহত রয়েছে।
বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির মধ্যে মূল বেতন ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। এছাড়া ১ হাজার ২৮০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৩২০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ২০০ টাকা যাতায়াত ভাতা এবং খাদ্য ভর্তুকি বাবদ রয়েছে ৩০০টাকা। ন্যূনতম মজুরি বিধিমালা-১৯৬১-এর সপ্তম ধারা অনুযায়ী সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের এই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন হতে হবে ১৬ হাজার টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের এই শিল্পে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ হলেও মজুরি কাঠামো সব কারখানায় ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না বলেও অভিযোগ উঠেছে কখনও কখনও।
২০১২ ও ২০১৩ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে। পরে বিদেশি ক্রেতাদের চাপে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এখন ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২, পাকিস্তানে ৯৯, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ও মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্যান্য শিল্প খাতের তুলনায় গার্মেন্ট শিল্প দ্রুত বর্ধনশীল। জিডিপিতে এই খাতের অবদানও তুলনামূলক বেশি। এই শিল্প থেকেই দেশের ৭৮ ভাগ রফতানি আয় হয়। অথচ পোশাক শিল্প খাতেই বেতন সবচেয়ে কম। দেশের উল্লেখযোগ্য ১০টি শিল্প খাতের মধ্যে পোশাক শ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম। ২০১০ থেকে ১২ সালের মধ্যে গঠিত বিভিন্ন ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে ঘোষিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, বর্তমানে নির্মাণশিল্প ও কাঠের কাজ করেন এমন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৮২ টাকা। ট্যানারি শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ৯ হাজার ৩০০ টাকা। তেল মিলের শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৪২০ টাকা। ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহনে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, রি-রোলিং মিলে ৬ হাজার ১০০ টাকা, কোল্ড স্টোরেজে ৬ হাজার ৫০ টাকা, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস কারখানায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত আছে। এমনকি ধান ভাঙানোর চাতালে আধা দক্ষ শ্রমিকের মজুরিও এখন ৭ হাজার ১৪০ টাকা। সল্ট (লবণ) ক্রাশিং শিল্পে মজুরি ঘণ্টায় ২৬৫ টাকা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য মতে বাংলাদেশের প্রকৃত জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ শতাংশের বেশি, যেখানে ন্যূনতম মজুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬০টিরও বেশি দেশে বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের নীতি প্রচলিত আছে। বলা বাহুল্য, সে নির্ধারণে পদ্ধতিগত ভিন্নতা আছে। শুধু গড় মূল্যস্ফীতি নয়, জাতীয় আয়ের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ন্যূনতম মজুরির ধারাবাহিক সমন্বয় সাধন সারা বিশ্বে একটি সাধারণভাবে প্রচলিত ও স্বীকৃত পদ্ধতি।
Comments (No)