যেভাবে আপনার সন্তানের মিথ্যা বলা বন্ধ করবেন ও সত্য বলা শেখাবেন 1

মাঝে মধ্যে দেখা যায় শিশুরা মিথ্যা কথা বলছে। এতে আপনি বিচলিত হয়ে পড়তেই পারেন। এইটুকু শিশু কিনা মিথ্যা কথা বলতে শিখে গেছে? তাতে হতাশ হতে পারেন, হতে পারেন বিরক্তও। তবে অবশ্যই আপনাকে মনে রাখতে হবে শিশু বয়সে মিথ্যা কথা বলা ভুল হতে পারে। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়! শিশুদের মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করতে হলে আগে জানতে হবে কোনো তারা মিথ্যা কথা বলছে।

আপনি কি আপনার সন্তানের মিথ্যা কথা বলা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন? সন্তানের এই মিথ্যা কথা আপনাকে হতাশ করছে? সন্তানের মিথ্যা কথা বলা নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় আছেন, আজকে তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই আমার এই লেখা। পুরো লেখা জুড়েই আপনার জন্য এমন কিছু পরামর্শ থাকবে যার মাধ্যমে খুব সহজেই আপনার সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে ফেরাতে পারবেন।

আমরা জানি, শিশুরা হলো অনুকরণ প্রিয় আর এই অনুকরণ করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কোনো পিতা মাতা চাইবে না তার সন্তান মিথ্যা কথা বলুক। কিন্তু সামাজিকীকরণের কারণে অনেক সময় আপনার সন্তান সত্যের চেয়ে মিথ্যাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে শুরু করে।

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে আপনার সন্তানের মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করবেন ও সত্য কথা বলা শেখাবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।

নিজেরা সত্য কথা বলুন :

আপনার সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারের সবাইকে সত্য কথা বলা। কারণ, আপনাকে দেখেই আপনার সন্তান শিখবে৷ যদি পরিবারের কর্তারাই মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তাহলে শিশুটিও যে মিথ্যা কথা বলবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

তাই, পরিবারের সবারই উচিত এই ব্যাপারে সর্বদা সর্তক থাকা। সন্তানের সামনে এমন কিছু বলবেন না, যা তাকে মিথ্যা কথা বলতে প্রলুব্ধ করে। এজন্য সর্বদা এই বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।

নীতিবাক্য শেখান :

শিশুরা কখনো সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এই সময় শিশুদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়, তারা তাই শিখে। চেষ্টা করুন সবসময় শিশুকে নীতিবাক্য শেখানোর জন্য। যেমন- মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ বা ঈশপের কোনো গল্প যেখানে মিথ্যাবাদীকে খারাপ হিসাবে দেখানো হয়।

শিশুকে ভালো ও খারাপের মধ্যে পার্থক্য ধরিয়ে দিতে পারেন। যেমন- কথাটা এভাবে না বলে এভাবে বলতে পারো, তাহলে তোমার কথা সবাই পছন্দ করবে। এছাড়াও, রাজার নতুন কাপড়ের গল্প বা বালকের মিথ্যা বাঘের গল্পটিও শোনাতে পারেন।

শিক্ষামূলক পড়া ও খেলায় ব্যস্ত করে দিন :

শিশুরা বেশিরভাগ সময় মিথ্যা কথা বলা শেখে অন্য শিশুদের নিকট থেকে। যদি বাইরে খেলাধুলা করা কিংবা অন্যদের সাথে মিশতে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই ভালো। তবু আপনি খেয়াল করে দেখবেন আপনার সন্তানটি অন্যদের সাথে খেলার থেকেও বেশি আনন্দ পায় মোবাইলে গেম খেলে।

তাই আপনার সন্তানকে শিক্ষামূলক অ্যাপ ও গেমস খেলতে দিন। এতে করে সে সাধারণত যেসব কাজে মিথ্যা কথা বলে থাকে, সেগুলো থেকে একদিকে যেমন দূরে থাকবে, অন্যদিকে অনেক কিছু শিখতে পারবে। তাছাড়া এই ধরনের অ্যাপ বা গেমস তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায়ও কাজে লাগবে। যেমন- ছোটদের জন্য অনেক অংক শেখার অ্যাপ আছে। আর তার যদি নিজস্ব ট্যাব থাকে, তবে সেটিতে ডাউনলোড করে দিন আর না থাকলে আপনার মোবাইলেই ডাউনলোড করে নিন।

ছোটরা ছবি আঁকতে অনেক ভালবাসে, সেই সাথে এটি তাদের স্কুলের সিলেবাসেও থাকে। তাই আপনার সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত রাখার জন্য ছবি আঁকা শেখার অ্যাপ ও গেমস খেলতে দিয়ে ব্যস্ত রাখুন। দেখবেন সে সারাদিন এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। দুষ্টুমি করার সুযোগ কম পাবে আর সেই দুষ্টুমির জন্য মিথ্যা বলারও আর প্রয়োজন হবে না।

মিথ্যা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করুন :

যদি কোন বস্তুকে মিথ্যা বলার কারণ শিশুকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেন, তাহলে তার জন্য বুঝতে সুবিধা হয়। ধরুন- সে আবদার করে বসলো যে, সে চাঁদ হতে চায়। এখন তাকে জিজ্ঞেস করুন বাস্তবে কি চাঁদ হওয়া সম্ভব কিনা। এভাবে শিশুর প্রশ্নের উত্তর দিন যাতে সে কনফিউশনে না থাকে।

শিশুর প্রশ্নকে কখনো এড়িয়ে যাবেন না ও ছোট করে দেখবেন না। কারণ শিশুকাল থেকে শিখে আসা প্রত্যেকটা বিষয়ই একেবারে মনের মধ্যে বসে যায়। ছোটবেলায় শেখা মিথ্যা কথাটিই তার কাছে সত্য বলে মনে হয়। তার জীবনের সকল কাজে কর্মে ছোটবেলা থেকে শিখে আসা জ্ঞান প্রতিফলিত হয়। তাই সন্তানকে মিথ্যা ও সত্যের মাঝে পার্থক্য করতে শেখান।

সন্তানকে সুযোগ দিন :

আপনার সন্তান যখন মিথ্যা কথা বলবে তখন তাকে ভয় না দেখিয়ে তার পাশে দাঁড়ান। তাকে একবার সত্য কথা বলার সুযোগ দিন। তাকে বলুন আমি তোমাকে আরেকবার সুযোগ দিচ্ছি তুমি সত্য করে বল। দেখবেন সে আপনাকে সত্য কথা বলবে। এভাবে সত্য কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

সাইকোলজিতে একটা কথা আছে, যে ব্যক্তি কোনো কাজ একটানা একুশ দিন নিয়মিত করে বা কোনো কাজ থেকে একুশ দিন দূরে থাকে, সেই ব্যক্তি ঐ কাজকে নিজের অভ্যাসে পরিনত করে তোলে। অথবা সে অভ্যাস আজীবনের জন্য ত্যাগ করে। তাই সন্তানকে একটানা একুশ দিন মিথ্যা বলা থেকে দূরে রাখুন, দেখবেন আপনার সন্তান মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে।

সত্য বলার জন্য পুরস্কৃত করুন :

শিশুরা সবসময় ভালবাসা আর একটু স্নেহ মমতা খোঁজে। তাই সন্তানকে সত্যের পথে আনতে চাইলে ভয় না দেখিয়ে তাকে আদর আর স্নেহ দিয়ে বোঝান। কঠোর না হয়ে কোমল ভাবেই তাকে মিথ্যা থেকে দূরে রাখুন। এজন্য আপনি একটা কাজ করতে পারেন সন্তানের প্রত্যেকটা সত্য কথা বলার জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন। তাকে বলুন সত্য কথা বললে পুরস্কার দিবো।

এতে করে আপনার সত্য কথা বলার প্রতি আপনার সন্তানের আগ্রহ কয়েক গুন বেড়ে যাবে। এভাবেই দেখবেন আপনার সন্তানও আপনার কথায় রাজি হয়ে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকবে।

মিথ্যা বলার কুফল বলুন :

ন্যাচারালি আমরা জানি মিথ্যা কথা বলার পরিনাম খুব খারাপ হয়। আর এই কথাটাই আপনার সন্তানকে বলুন। মিথ্যা কিভাবে মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে আর সত্য কথা বলার সম্মান কতোটা বেশি তা অনুভব করাতে শেখান।

এমন সব গল্প বা সত্য ঘটনা তার নিকট উপস্থাপন করুন যা তার সত্য বলার উৎসাহকে কয়েক গুণে বাড়িয়ে তোলে।

ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকুন :

যদি আপনি আপনার সন্তানকে ভয় দেখিয়ে সত্য কথা বলাতে চান, তাহলে হিতের বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তাই আপনার সন্তানকে সব সময় স্নেহের সাথে সত্য কথা বলতে শেখান।

ভয় দেখালে আপনার সন্তান আপনার নিকট থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। তাই ভয় না দেখিয়ে আপনার সন্তানকে স্নেহ আর ভালবাসায় সত্য বলার অভ্যাস করুন।

অনুতপ্ত বোধ শেখান :

যদি কখনও আপনার সন্তান মিথ্যা কথা বলে, তাহলে তাকে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে শেখান। এতে করে আপনার সন্তান বুঝতে পারবে মিথ্যা বলা কতটা খারাপ হতে পারে। একদিকে যেমন সত্য কথা বলার পুরস্কার, তেমনি অন্যদিকে মিথ্যা কথা বলার পরিনাম কি হতে পারে সেই বিষয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন।

সন্তানকে সময় দিন :

বেশিরভাগ অভিভাবক কেই এই ভুলটি করতে দেখা যায়। সন্তানকে সময় না দেওয়ার কারণে অনেক সময় সে উল্টো দিকে চলতে শুরু করে। এতে করে আপনার সন্তান বিপদগামী হতে পারে। তাই সকল অভিভাবকের উচিত তার সন্তানকে সময় দেওয়া।

এতে করে সন্তান মা বাবার নিকট থেকে ভাল কিছু শিখতে পারবে। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তার ভবিষ্যতকে আরো বেশি উজ্জ্বল করতে পারে।

শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শন :

এটি অনেক বেশি কার্যকরী ও দূর্দান্ত একটি উপায়। যে কথাটি আপনার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না, সেই কথাটিই খুব সহজেই আপনি আপনার সন্তানকে শিক্ষামূলক চলচিত্র দেখিয়ে শেখাতে পারেন। এতে আপনার সন্তান খুব দ্রুত অনুভব করতে শিখবে ও মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে।

আশাকরি উপরে আলোচনা করা প্রত্যেকটা উপায় আপনার সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে ফেরাতে ও সত্য কথা বলা শেখাতে আপনাকে সাহায্য করবে। আপনি যদি মনে করেন যে, সব বাবা মায়েরই এই কথা গুলো জানা উচিত, তাহলে এই লেখাটি শেয়ার করে আপনার মত অন্যান্য সকল বাবা মাকেও জানিয়ে দিন। সবাইকে ধন্যবাদ!

By arjoda

Leave a Reply

You missed

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ