মাংসের আচারে বাজিমাত করলেন বগুড়ার মাসুমা / Masuma of Bogra played the meat ritual 2023 করোনার প্রভাবে দেশে অনেকেই ব্যবসায়িকভাবে হয়েছেন মারাত্মক ক্ষতির শিকার। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। তাদের মধ্যে একজন বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা মাসুমা আক্তার। তিনি দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে মাংসের আচার তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করে হয়েছেন সাবলম্বী।
স্বামী রাজিবুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা করছেন মাসুমা আক্তার। তার মাংসের আচার দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৭টি দেশে গেছে। এখনো বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত আচারের অর্ডার আসছে তার কাছে।
মাসুমা আক্তার বগুড়া শহরের কৈগাড়ি পূর্বপাড়া এলাকার রাজিবুল ইসলামের স্ত্রী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম আরএম ফুড কর্ণার। মাংসের আচারের পাশাপাশি ঘিসহ বিভিন্ন ধরণের আচার, লাচ্ছা সেমাইয়ের মতো পণ্যও রয়েছে আরএম ফুড কর্ণারের ব্যানারে।
মাসুমা আক্তার বলেন, আমার স্বামী বগুড়ার একটি চার তারকা হোটেলে হিসাব বিভাগে চাকরি করতেন। করোনার প্রভাবে আমার স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ার পর আমরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ি। পরিবার নিয়ে আর্থিক অভাবের মধ্যে ডুবে যাবো এমন অবস্থা হয়েছিল।
সে সময় আমার শিশু কন্যার মাটির ব্যাংকে জমানো ৩০০ টাকা দিয়ে আলুর চিপস বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। কিছু টাকা হলে কাপড়ের ব্যবসার মাধ্যমে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করি। কিন্তু এই ব্যবসায় ভালো কিছু হচ্ছিল না। পরে মাংসের আচার করে অনলাইনে বিক্রির পরিকল্পনা করি। আচার বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার চালানোর পর ভালো সাড়া পাই। এরপর থেকে আমাদের দুশ্চিন্তা মিলিয়ে যায়।
মাংসের আচারের পরিকল্পনা পেলেন কিভাবে জানতে চাইলে মাসুমা আক্তার বলেন, অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে আসলে ইউনিক কিছু না হলে সহজে সফল হওয়া যায় না। আমার কাছে মাংসের আচারটাকে ইউনিক মনে হয়েছে। মাংসের আচার আমি শিখেছি আমার শাশুড়ির কাছে।
তার কাছে গল্প শুনেছি, যখন সবার বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না ওই সময় কোরবানির ঈদে প্রত্যেকের বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার চেয়েও অতিরিক্ত মাংস থাকতো। তখন সেই মাংস শুকিয়ে আচার করে রাখা হতো। সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া যেত। ওই সময় আমার এই বিষয়টি মাথায় আসে।
তখন প্রাথমিকভাবে আধা কেজি মাংস দিয়ে আচার তৈরি করে ফেসবুকে প্রচার করি। অনেকেই আমার কাছে অর্ডার দেয়। এভাবে অনলাইনে যারা কিনতেন তাদের মুখে মুখে এবং আমার ফেসবুক প্রচারণাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে আমার সফলতা দ্রুত আসে।
তিনি আরও বলেন, অর্ডারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়। ওই সময় আমি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নেই। ওই ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। পরে আবারও ঋণ নিয়েছি। ওই টাকা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছি।
মাংসের আচার তৈরিতে আপনার শাশুড়ির রেসিপিই ব্যবহার করেন নাকি নতুন কিছু সংযোজন বিয়োজন করেছেন জানতে চাইলে মাসুমা আক্তার বলেন, রেসিপি তো পুরোটাই শাশুড়ির। গরুর মাংস, সরিষার তেল, রসুন, হলুদ, মরিচ, সরিষা, আর বিভিন্ন মশলার সমন্বয়ে টক ঝাল স্বাদের আচার তৈরি হয়। তবে আমি এর মধ্যে নতুন কিছু মসলা যোগ করেছি। যে কারণে টেস্ট আরও বেড়ে গেছে।
শুরুতে এই আচার ১ হাজার টাকা কেজি বিক্রি করলেও দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে প্রতি কেজি ১৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। বর্তমানে হাড়-চর্বি ছাড়া ফ্রেশ মাংস কিনতে খরচ পড়ছে প্রতি কেজি ৮৫০ টাকা। বিভিন্ন সাইজের বোয়েমে ভরে তিনি আচার বিক্রি করছেন। ২৫০ গ্রাম ওজনের এক বোয়েম মাংসের আচারের দাম ৩৫০ টাকা।
প্রচার পাওয়ার পর প্রথম দিকে মাসে ২০ থেকে ২৫ কেজি মাংসের আচারের অর্ডার পেতেন। এখন তিনি মাসে ২৫০-৩০০ কেজি আচারের অর্ডার পান। মাসে ১০০ কেজির ওপর মাংস দেশের বাইরে যায়। আর বাকি আচারের অর্ডার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসে। সব মিলিয়ে মাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার আচার বিক্রি করছেন মাসুমা আক্তার।।
মাসুমা আক্তার বলেন, দেশের ভেতর তার মাংসের আচারের ক্রেতা বেশির ভাগ কলেজ ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। যারা মেসে বা হোস্টেলে থাকে। কারণ মাংসের আচার সংরক্ষণ এবং খাওয়ায় অনেক সুবিধা আছে। আচার ফ্রিজে রাখতে হয় না। গরম করার প্রয়োজন পরে না। আবার ভাত, খিচুরী বা রুটি দিয়ে যখন খুশি তখন খাওয়া যায়।
বিদেশে কিভাবে মাংসের আচার পাঠাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশগামীদের হাতে এ পর্যন্ত কানাডা, লন্ডন, আমেরিকা, চীনসহ ১৭টি দেশে আচার পাঠিয়েছেন। এখনও বিভিন্ন দেশ থেকে ১০০ কেজি, ১৫০ কেজি করে অর্ডার আসছে। সর্বশেষ কানাডায় ৮ কেজি আচার স্যাম্পল হিসেবে পাঠিয়েছেন। ভালো লাগলে তারা আরও বেশি অর্ডার করবেন বলে জানান তিনি।
মাসুমা আক্তার বলেন, অর্ডার অনুযায়ী পণ্য তিনি দিতে পারছেন না লাইসেন্স জটিলতায়। বিদেশে রপ্তানির জন্য লাইসেন্স করতে গেলে গরুর মাংসের আচার লেখা যাবে না। লেবেলে গরুর মাংসের আচার লেখা যাবে না- এরকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
মাসুমা আক্তার বলেন, আমি তো নতুন উদ্যোক্তা। আমরা বুঝতে পারছি না মাংসের আচারের জন্য লাইসেন্স কোথায় গেলে সহজভাবে পেতে পারি। তবে আমাকে গ্রাম উন্নয়ন কর্ম (গাক) থেকে পণ্যের বাজারজাত সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন এবং সহযোগিতা করছেন। দেশের বাইরে পণ্য পাঠানো এবং বায়ারদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করবো সব ব্যবস্থা তারা করে দিচ্ছে।
মাসুমা আক্তারের স্বামী রাজিবুল ইসলাম বলেন, মাংসের আচারে সফলতা পাওয়ার পর তিনি নতুন করে আর কোথাও চাকরিতে জয়েন করেননি। আরএম ফুড কর্ণারের যাবতীয় দেখাশোনা তিনি করছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে চেষ্টা করছেন তাদের ব্যবসাকে আরো বড় করার।
তিনি বলেন, এক সময় মায়ের হাতে রান্না করা মাংসের আচার খেয়েছি। এখন ব্যবসার পাশাপাশি মাংসের আচার খেতে পারছি। আচার খেতে গিয়ে মায়ের হাতে রান্না করা মাংসের আচারের কথা মনে পড়ে যায়। সেই স্বাদের কথা মনে পড়ে যায়।
বগুড়ার গ্রাম উন্নয়ন কর্ম (গাক) এর জ্যেষ্ঠ পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, মাংসের আচার মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও আমরা ভূমিকা রাখছি। মাসুমা আক্তার যাতে তার পণ্য সহজে দেশে বিদেশে সরবরাহ করতে পারেন তার জন্য কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
আচার রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বগুড়ার আমদানি ও রপ্তানি সহকারী নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের সহকারি নিয়ন্ত্রক সৌরভ হাসান। তিনি বলেন, দেশ থেকে কোনো পণ্য রপ্তানি করতে হলে একটি এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ইআরসি) নিতে হয়।
ইআরসি প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি। ইআরসি নেওয়ার প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ। স্বীকৃতি ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য সনদ থাকলেই আমরা এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেই। সেক্ষেত্রে তারাও কিন্তু সহজেই সার্টিফিকেটটি পেতে পারেন।