ধান আমাদের জীবিকা নির্ভরের মাধ্যম। আউশ ধান আমন-বোরোর মতো যত্ন নিলে ফলন কোনো অংশেই কম হয় না। ধান সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়, জীবনকাল কম এবং জল সাশ্রয়ী। জ্যৈষ্ঠ মাসে একটু বৃষ্টি পেলেই ধানের জমি সবুজ ধানে ভরে যায়। এ জন্য ধান আবাদে বৃষ্টি ছাড়া অতিরিক্ত পানির তেমন দরকার হয় না। সার দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও বোরোর চেয়ে কম। এক সময় সারাদেশে অনেক এলাকাজুড়ে এ ধানের আবাদ করা হতো।
আমাদের দেশে শুকনো মওসুমে বোরো চাষে সেচ কাজে জলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়- যা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ জল অধিক উত্তোলন করা হয়। ফলে ভূ-গর্ভস্থ জলের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে ও ভৌগোলিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তাই বোরো এলাকা আর না বাড়িয়ে বরং আউশ ধানের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার।বাংলা আশু শব্দ থেকে আউশ শব্দের উত্পত্তি। আউশ মানে আশু ধান্য। আশি থেকে একশ বিশ দিনের ভেতর এ ধান ঘরে তোলা যায়। দ্রম্নত (আশু) ফসল উত্পন্ন হওয়ার বিচারে এই ধানের এমন নামকরণ হয়েছে। খনার বচনে আছে ‘আউশ ধানের চাষ, লাগে তিন মাস, কোল পাতলা ডাগর গুছি, লক্ষ্ণী বলে হেথায় আছি অর্থাত্ আউশ ধান চাষে তিন মাস লাগে। ফাঁক ফাঁক করে লাগালে গোছা মোটা হয় এবং ফলনও বেশি হয়’। আরো সহজ কথায় আউশে আমন-বোরোর মতো যত্ন নিলে ফলন কোনো অংশেই কম হয় না। আউশ সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়, জীবনকাল কম এবং জল সাশ্রয়ী। কথায় আছে জ্যৈষ্ঠে খরা ধানে ভরা। অথ্যাত্ জ্যৈষ্ঠ মাসে একটু বৃষ্টি পেলেই আউশের জমি সবুজ ধানে ভরে যায়। এ জন্য আউশ আবাদে বৃষ্টি ছাড়া অতিরিক্ত পানির তেমন দরকার হয় না। সার দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও বোরোর চেয়ে কম।
এক সময় সারাদেশে অনেক এলাকা জুড়ে এ ধানের আবাদ করা হতো। আমাদের দেশে শুকনো মওসুমে বোরো চাষে সেচ কাজে জলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়- যা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলন করা হয়। ফলে ভূ-গর্ভস্থ জলের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে ও ভৌগোলিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। ব্রির গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি কেজি চাল উত্পাদনে ২০০০-২৫০০ লিটার জলের প্রয়োজন যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল তাই বোরো এলাকা আর না বাড়িয়ে বরং আউশের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। স্বাধীনতার পরপর আউশের জমি ছিল ৩.০ মিলিয়ন হেক্টর। আর বোরোর জমি ছিল ১ মিলিয়ন হেক্টরের কাছাকাছি। বোরো শুধু হাওর আর বিল এলাকার আশপাশে চাষ করা হতো। আউশ করা হতো কিছুটা উঁচু জায়গায়। দুরকমের আউশ হয়। যেমন- বোনা ও রোপা আউশ।
বোনা আউশ: বোনা আউশে সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে (১০ চৈত্র হতে ১০ বৈশাখ) বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের জন্য হেক্টর প্রতি ৭০-৮০ কেজি বীজ ছিটিয়ে বপন করে হালকাভাবে একটা চাষ ও মই দিয়ে মাটি সমান করতে হয়। সারি করে ২৫ সে.মি. দূরত্বে ৪-৫ সি.মি. গভীর সারি করতে হয়। এতে হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। তারপর মই দিয়ে মাটি সমান করতে হয়। ডিবালং পদ্ধতিতে বাঁশ বা কাঠের দন্ড দিয়ে ২০ সি.মি. পরপর মাটিতে গর্ত করে প্রতি গর্তে ২/৩ বীজ বপন করে মই দিয়ে সমান করে দিতে হয়। এই পদ্ধতিতে বীজ হার হলো ২৫-৩০ কেজি/হেক্টর। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনো বীজ মাঠের ওপরে না থাকে। জমিতে প্রচুর পরিমাণে রস থাকলে বীজ বপন করতে হবে। চারাগুলোর ১ সপ্তাহ পর আঁচড়া দিয়ে জমির মাটি আলাদা করে দিতে হবে। এতে চারার ঘনত্ব ঠিক থাকবে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হবে, আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
রোপা আউশ: বীজ বপনের সময় হলো ১৫ চৈত্র হতে ৫ বৈশাখ (৩০ মার্চ-১৫ এপ্রিল) এবং চারা রোপণের সময় ৫-৩০ বৈশাখ (১৫ এপ্রিল -১০ মে)। উর্বর ও উঁচু জমিতে বীজতলা করতে হবে যেখানে হঠাত্ বৃষ্টিতে/বন্যায় জল উঠার সম্ভবনা নেই। এ ক্ষেত্রে চারার বয়স হবে ১৫-২০ দিনের এবং রোপণ দূরত্ব রাখতে হবে সারি থেকে সারি ২০ সে.মি. ও চারার দূরত্ব ১৫ সে.মি.।
সম্পূরক সেচঃ আউশ চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টি নির্ভর। তবে প্রতি বত্সর সব স্থানে বৃষ্টিপাতের ধরন এক রকম হয় না। এমন কি একই বছরে একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বিশেষত বোনা আউশে এশটি বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসলে বীজ ছিটানো হয়। যদি সময়মতো বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে যে কোনো পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাব দেখা দিলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। একইভাবে রোপা আউশের সময়ও যদি প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হয় তবে বৃষ্টির আশায় না থেকে প্রয়োজনে একাধিক সম্পূরক সেচ দেয়া যেতে পারে। এ জন্য আউশ মৌসুমে নিশ্চিত ভালো ফলনের জন্য ধান জমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে।
বীজ বপনঃ বোনা আউশের বীজ তিনভাবে বপন করা যায়-ছিটিয়ে- এতে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন ভালো বীজ হেক্টরপ্রতি ৭০-৮০ কেজি হারে বুনে দিতে হবে, এরপর হাল্কাভাবে একটা চাষ ও মই দ্বারা মাটি সমান করতে হবে।
সারি করে- এতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৪-৫ সে.মি. গভীর করে সারি তৈরি করতে হবে এবং হেক্টর প্রতি ৪৫-৫০ কেজি হারে বীজ বপন করতে হবে। এবার মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
ডিবলিং পদ্ধতিতে- এতে বাঁশ বা কাঠের দন্ড দিয়ে ২০ সেন্টিমিটার পর পর মাটিতে গর্ত করে গর্তপ্রতি ২/৩ টি করে বীজ বপন করে মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে বপনের জন্য বীজের হার হলো হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি।
সার ব্যবস্থাপনাঃ মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ফলন মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন। বোনা/রোপা আউশে ইউরিয়া- টিএসপি-এমওপি-জিপসাম- দস্তা (মনোহাইড্রেট) হেক্টর প্রতি ১৩৫ – ৫৫- ৭৫ – ৩৫- ৫ হারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় বোনা আউশের সব সারই প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশে ইউরিয়া সমান দুকিস্তিতে প্রয়োগ করলে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। ১ মণ কিস্তি শেষ চাষের সময় ও ২য় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর।রোপা আউশে ইউরিয়া ১ কিস্তি (১/৩) শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি (১/৩) ৪-৫টি কুশি দেখা দিলে (সাধারণত রোপনের ১৫-১৮ দিন পর) এবং ৩য় কিস্তি (১/৩) ইউরিয়া কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শুধুমাত্র জিপসাম এবং দস্তা (মনোহাইড্রেট) প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে বোনা আউশ ধানে আগাছার খুবই উপদ্রব হয়। সময়মতো আগাছা দমন না করলে শতকরা ৮০-১০০ ভাগ ফলন কমে যায়। সাধারণত হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে অথবা আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা যায়। হাত দিয়ে আগাছা নিড়ানো কষ্টকর ও শ্রমসাধ্য। এ ক্ষেত্রে বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর প্রথমবার এবং ৩৫-৪০ দিন পর দ্বিতীয়বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। সারি করে বপন বা রোপণ না করলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা সহজ ও সাশ্রয়ী।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ নিবিড় চাষাবাদের কারণে আউশে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আউশে মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পামরী পোকা, থ্রিপস, পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধি পোকা ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। পোকার ক্ষতির মাত্রা, পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদি দেখে প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে বোরো, আউশ এবং রোপা আমন মওসুমে যথাক্রমে শতকরা ১৩, ২৪ এবং ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ আউশে ৬টি রোগকে প্রধান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- খোলপোড়া ও খোলপচা রোগ, বাকানি রোগ, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও লালচে রেখা রোগ এবং টুংরো রোগ ইত্যাদি।
সম্ভাবনা ও সুপারিশঃ কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টাল থেকে জানা যায়, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭৪.৪৮ লাখ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি ২.২৩ লাখ হেক্টর। সেচ নির্ভর জমি বোরো উত্পাদনে ছেড়ে দিয়ে দেশজুড়ে থাকা আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আউশ আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে গড় ফলন ৩.০ টন/ হে. ধরলেও বিপুল পরিমাণ ফলন জাতীয় উত্পাদনে যোগ হবে। সেচ নির্ভর বোরো ধান আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় সর্বাধিক অবদান রাখা সত্ত্বেও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ও ভৌগলিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন্ন রাখার স্বার্থে বোরো আবাদি এলাকা যথাসম্ভব কমিয়ে পানি সাশ্রয়ী আউশের আবাদ বৃদ্ধি করা জরুরি।
Comments (No)