ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন

ইটের তৈরি যেকোন আবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন বা কলকারখানার ছাদে নান্দনিক বাগান গড়ে তোলা যায়। পাকা বাড়ির খালি ছাদে বেড তৈরি করে অথবা টবে বা ড্রামে চাষাবাদ করে যে বাগান গড়ে তোলা হয় তাকেই ছাদবাগান বলা হয়। ছাদবাগানে যেমন ফুল ও শোভাবর্ধনকারি গাছ রোপন করা যায়, তেমনি ফল, শাকসবজি, মশলা, ওষধি গাছসহ নানাবিধ উদ্যান ফসলও চাষাবাদ করা যায়। এতে করে একদিকে টাটকা ও নিরাপদ খাবারের সংস্থান করা যায়, অন্যদিকে শহুরে যান্ত্রিক জীবনেও সুশীতল ছায়া, পশুপাখির আশ্রয়, খেলা ও বিনোদনের স্থান নিশ্চিত করা যায়। খোরাক যোগায় অবসরের।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 1

নগরে অবকাঠামো বা আবাসস্থল তৈরিতে যে পরিমাণ সবুজায়িত স্থান বা চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার কিছু অংশ ভবনের ছাদে বাগান করার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এটি একদিকে যেমন বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিবে, অন্যদিকে দৈনন্দিন বাজার খরচ কমাতেও সহায়তা করে। পাশাপাশি শিশুরা সবুজের কাছাকাছি একটি মনোরম পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে। ছাদবাগান বাড়ির টপ ফ্লোরকে তুলনামুলক শীতল রাখে। দূষণমুক্ত রাখে পরিবেশ। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছাদবাগানের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর তাই ছাদে একটি পরিকল্পিত বাগান গড়ে তুলতে চাইলে প্রথমেই কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা জরুরি।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 2

বাড়ির ছাদে একটি বাগান করার জন্য মনঃস্থির করলে আমরা প্রথমেই যে ভুলটি করি তা হলো, বিভিন্ন নার্সারি বা মেলা ঘুরে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী গাছপালা কিনতে আরম্ভ করি যা মোটেও উচিৎ নয়। বাগানের জন্য গাছ কেনার কাজটি একটি পরিকল্পিত ছাদবাগান করার সর্বশেষ ধাপ।  বাগানের জন্য ছাদের যেন কোন প্রকার ক্ষতি না হয় সেই বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। ছাদটি দীর্ঘমেয়াদে গাছপালার কতটুকু ভার বহনে সক্ষম তা আগে জেনে নিতে হবে। আধুনিক স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত নতুন দালান থেকে শুরু করে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরের পুরনো বাড়িগুলোতেও খুব সহজেই পূর্ণাঙ্গ ছাদবাগান গড়ে তোলা যায়।  ষাট থেকে সত্তর বছরের পুরাতন বাড়ির ছাদগুলো আংশিক বাগান করার উপযোগী। বিশেষ ক্ষত্রে তুলনামূলক পুরাতন ভবনের ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে স্থাপনার বিম ও কলামগুলোকে অধিক  গুরুত্ব দিয়ে গাছপালা সাজানো যেতে পারে। তবে বেশ পুরনো, ঝূঁকিপূর্ণ ও অধিক গাছপালার ভার সহ্য করতে সক্ষম নয়, এমন ছাদে বাগান করা মোটেও উচিত নয়।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 3

ছাদ বাগানের জন্য মাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে বাড়ি করার সময় গর্ত বা পাইলিং এর মাটি বাগানের জন্য সংরক্ষণ করেন। পরে তা গাছ রোপণে ব্যবহার করেন যা ছাদবাগানের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। ছাদবাগানের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মাটি হলো বেলে-দোঁয়াশ। সম্ভব হলে গাছ লাগানোর আগে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে চেলে নিতে হবে। শাক-সবজি, মৌসুমী ফুল বা অগভীরমূলী গাছ লাগানোর জন্য ছাদের উপরিভাগে নির্মিত বেড় বা টবে ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি পুরু মাটির স্তর থাকলেই চলে। কিন্তু ফলসহ মাঝারি ধরনের ও বড় শিকড়ের গাছের জন্য ড্রাম, টব বা বেড়ের মাটির গভীরতা কমপক্ষে দুই থেকে তিন ফুট হতে হবে।

ছাদ বাগানের মাটি উর্বর করতে গরুর গোবর সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও কার্যকরী জৈব সার। তবে কাঁচা গোবর ব্যবহার না করাই ভালো। এটি ছায়ার রেখে ভালোভাবে শুকিয়ে মাটির সাথে এক তৃতীয়াংশ হারে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি জৈব সার, কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট ইত্যাদি উপাদান মাটির সাথে পরিমিত পরিমানে বা এক তৃতীয়াংশ হারে মিশিয়ে উপযুক্ত মাটি প্রস্তুত করা যেতে পারে।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 4

ছাদবাগান করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জমে থাকা পানি দ্রুত ছাদ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কোনভাবেই ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাঁতস্যাঁতে হতে না পারে। গাছের পাত্র থেকে বের হওয়া পানি যেন কোনভাবেই ছাদে জমতে না পারে। এজন্য, ড্রাম বা টবগুলোকে রিং বা ইটের উপর রাখা যেতে পারে। এতে পাত্রের নিচে দিয়ে আলো বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও স্যাতসেঁতে হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। গাছ লাগানোর জন্য ছাদে স্থায়ী বেড় বানাতে চাইলে তা ছাদ থাকে অন্তত আট ইঞ্চি উপর থেকে শুরু করতে হবে।  ওয়াটার প্রুফিং, নেট ফিনিসিং বা চিপস ঢালাইয়ের মাধ্যমেও ছাদকে ড্যাম্প প্রতিরোধী করা যায়।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 5

অপেক্ষাকৃত বড় গাছপালা যেমন ফলজ গাছগুলো ছাদের বীম বা কলামের কাছাকাছি স্থান বরাবর রাখা উত্তম।

ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন 6

ভরদুপুরে বা কড়া রোদে অবশ্যই নতুন চারা লাগানো,  গাছে পানি দেয়া এবং বালাইনাশক প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। ভোর ও পড়ন্ত বিকেল চারা রোপন, পানি সেচ ও বালাইনাশক প্রয়োগের উপযুক্ত সময়।

ড্রামে লাগানো গাছে বছরের একবার বা দুইবার পরিমিত পরিমানে সার দেয়া যায়। নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত এবং ঘন ঘন সার দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে বেশি শীত ও বর্ষা মৌসুমে সার না দেয়া ভাল। ফলগাছে ফুল আসার অন্তত দু’মাস আগে সার দেয়ার কাজ শেষ করতে হবে। সেইসঙ্গে গাছের রোগাক্রান্ত ও মরা ডালগুলো ছাঁটাই করতে হবে। ফল সম্পূর্ণ তোলার পর মরা মুকুল, বোটাসহ ফলগাছের কিছু ডগা ভেঙ্গে দিতে হবে।

গাছের রোগবালাই দমনে পরিবেশ বান্ধব সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করা উত্তম। আর কীটনাশক প্রয়োগ করতে চাইলে সঠিক নিয়মে ও নির্দিষ্ট সময়ে ভালো কোম্পানির কীটনাশক প্রয়োগ করা শ্রেয়।

ছাদ বাগানের জন্য সৌন্দর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোন গাছ লাগিয়ে জঙ্গল করা চলবে না। গাছপালা ঘন হলে দ্রুত বাড়তে অসুবিধা হয় এবং এক গাছ থেকে আরেক গাছে দ্রুত রোগ সংক্রমিত হয়। এজন্য ছাদে বাগান করার আগে কতটুকু জায়গায় বাগান করবেন ও কি কি গাছ লাগাবেন তার একটা পরিকল্পনা ও নকশা করে নিতে পারেন। বাগান করার সর্বশেষ ধাপে সেই পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী মানসম্মত ও বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত গাছপালা কিনে তা সঠিক নিয়মে রোপণ ও পরিচর্যা করতে পারলে উদ্যোগটি পুরোপুরি সফল হবে।

Comments (No)

Leave a Reply

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ