চলনবিলের মিঠাপানির শুঁটকি, ১৩ কোটি টাকার সম্ভাবনাময় বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের মিঠাপানির শুঁটকির বাজার। মৌসুমে জালে ওঠা অতিরিক্ত মাছ রোদে শুকিয়ে বিক্রি করায় লাভবান হচ্ছেন জেলেরা। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় একসময় প্রচুর পরিমাণ মাছ পচে নষ্ট হতো। শুঁটকি তৈরি শুরুর পর থেকে এই এলাকার মাছের ব্যবসায় এসেছে বড় পরিবর্তন। সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান
দিন দিন বড় হচ্ছে নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের মিঠাপানির শুঁটকির বাজার। মৌসুমে জালে ওঠা অতিরিক্ত মাছ রোদে শুকিয়ে বিক্রি করায় লাভবান হচ্ছেন জেলেরা। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় একসময় প্রচুর পরিমাণ মাছ পচে নষ্ট হতো। শুঁটকি তৈরি শুরুর পর থেকে এই এলাকার মাছের ব্যবসায় এসেছে বড় পরিবর্তন। সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় পাঁচ মাস ধরে শুঁটকি তৈরি করছেন শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, মাছ চাষ করাই তার মূল পেশা। জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে আড়তে বিক্রি করতেন তিনি। চলনবিল অঞ্চলের শুঁটকি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় তিনি নতুন করে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
শহীদুল বলেন, “এখানে মিঠা পানির মাছের শুঁটকি করা হয়। অক্টোবর মাস থেকে শুরু করে পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জেলেরা শুঁটকি তৈরি করেন। এতে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। আর এখানকার মাছ সুস্বাদু হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে ক্রেতাদের চাহিদা।”
ডাহিয়া এলাকায় মাছের ব্যবসা করেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বর্ষাকালে আমরা প্রতিদিন প্রচুর মাছ ধরি। স্থানীয় বাজারে প্রতিদিন সব মাছ বিক্রি করতে পারি না। সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা না থাকায় আগে মাছ পচে যেতো। এখন আমরা নিজেরাই শুঁটকি তৈরি করছি এবং ভালো দামে বিক্রি করছি।”
নিংগইন শুঁটকি পল্লীর আরেক ব্যবসায়ী রাশেদুল ইসলাম নয়ন জানান, মাছের প্রজাতি, আকার এবং চাহিদার ওপর ভিত্তি করে শুঁটকির দাম নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত চিংড়ি মাছের শুঁটকি ৫শ’ টাকা কেজি, কাচকি ৬শ’ টাকা, লইট্টা ৬শ’, গুঁচি ৭শ’, চান্দা ৩শ’, বোয়াল ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা এবং শোল মাছের শুঁটকি ৮শ থেকে ১২শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।
আবদুস সালাম জানালেন কীভাবে শুঁটকি তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, “জেলেদের কাছ থেকে মাছ সংগ্রহের পরে নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করে লবণ মেশানো হয়। তারপর বাঁশের মাচায় টানা তিন দিন রোদে শুকানো হয়। বড় মাছ হলে কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হয়।”
সালাম আরও জানান, সৈয়দপুর, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও কিশোরগঞ্জ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে মাছ কিনে নিয়ে যান।
নাটোরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “চলতি মৌসুমে চলনবিল এলাকায় ৩১৭ টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৩ কোটি টাকা। এবার মাছের উৎপাদন ভালো হয়েছে, তাই আশা করা যাচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।”
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, “জেলে এবং ব্যবসায়ীরা যেনো লাভবান হন, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমরা ব্যবসা সম্প্রসারণে কাজ করছি। শুঁটকি তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ যেনো এখানে ব্যবহার করা না হয় সে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”
বৈদেশিক মুদ্রা আনছে সাতক্ষীরার মিঠাপানির শুঁটকি
সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে সাতক্ষীরায় উৎপাদিত হচ্ছে মিঠাপানির শুঁটকি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামেও যাচ্ছে এ অঞ্চলের শুঁটকি। ফলে একদিকে যেমন শুঁটকির মাছ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন মাছ চাষীরা।অন্যদিকে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীসহ এই কাজের সাথে জড়িতরা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শুঁটকি উৎপাদনকারী সাধন চন্দ্র রায় বলেন, গত সাত বছর ধরে মাছের শুঁটকি তৈরি করছি। সাধারণত সিলভার কার্প, পুঁটি, বাইন মাছ আড়ৎ থেকে কিনে এনে খামারে শুকিয়ে শুটকি তৈরী করছি।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিকের পাশাপাশি উৎপাদন করা হচ্ছে মিঠাপানির শুঁটকি। তিন-চার বছর ধরে এ শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। এসব শুঁটকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামে পাঠানো হচ্ছে এ অঞ্চলের শুঁটকি। ফলে একদিকে মাছ চাষীরা যেমন ভালো দাম পাচ্ছেন, অন্যদিকে শুঁটকি উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।
এসব শুঁটকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামে রফতানি হচ্ছে এ অঞ্চলের শুঁটকি।
বছরে প্রায় দুই লাখ টন সাদা মাছ উৎপাদন হয় উপকূলীয় এ জেলায়, যা স্থানীয় আমিষের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহের পাশাপাশি ভারতেও রফতানি হয়। গত তিন-চার বছর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যবসায়ী মিঠাপানির মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করছেন। তবে এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই আমার দপ্তরে। শুঁটকি উৎপাদনে কৃষক বা ব্যবসায়ীরা এগিয়ে এলে এ জেলায় বছরে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা যাবে।’
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস জানায়, চলতি বছর জেলার সাতটি উপজেলায় ৬৩ হাজার জলাশয়ে (পুকুর, ঘের, খাল ইত্যাদি) ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে মিঠা পানির মাছ চাষ করা হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টন। ২০০ টাকা কেজি দরে যার বাজার মূল্য দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
কার্প জাতিয় মাছের শুঁটকি উৎপাদনে সাতক্ষীরার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জেলায় বছরে বিপুল পরিমাণ মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয়। যা থেকে শুঁটকি উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তবে তথ্য সংরক্ষণ না থাকায় জেলায় কি পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয় তা মৎস্য অফিস জানাতে পারেনি।
শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আনুমানিক এক হাজার টন শুঁটকি প্রতিবছর সাতক্ষীরায় উৎপাদিত হয়। সাধারণত সিলভার কার্প, বাটা, তেলাপিয়া, পুঁটি ও মৃগেল মাছের শুঁটকি উৎপাদন করা হয় এ জেলায়।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শুঁটকি উৎপাদনকারী সাধন চন্দ্র রায় জানান, তিনি গত পাঁচ বছর ধরে মাছের শুঁটকি তৈরি করছেন। তিনি সাধারণত সিলভার কার্প, মৃগেল, বাটা, তেলাপিয়া ও পুঁটি মাছ কিনে এনে বেতনা নদীর ধারে তার খামারে শুকিয়ে থাকেন।
তিনি জানান, প্রতি মাসে তিনি প্রায় আট হাজার কেজি শুঁটকি মাছ উৎপাদন করেন। আর এসব শুঁটকি তিনি চট্রগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে সরবরাহ করেন। প্রতি মণ শুঁটকির পাইকারি দর সাধারণত ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা।
জেলার তালা উপজেলার ত্রিশমাইল এলাকায় শুঁটকি খামার মালিক রমেশ চন্দ্র খাঁ জানান, দুই বছরের বেশি সময় ধরে তিনি শুঁটকি মাছের আড়ৎ বানিয়েছেন। তিনি প্রতি মাসে চার হাজার কেজির মতো শুঁটকি বানিয়ে থাকেন। বিনেরপোতায় আরও একটি খামারে স্থানীয়ভাবে কম দামের ছোট তেলাপিয়া দিয়ে তিনি শুঁটকি তৈরি করেন। পরে এসব শুঁটকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন পোল্ট্রি ও মাছের ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।
তিনি আরও জানান, মিঠা পানির মাছের শুঁটকি উৎপাদনে সাতক্ষীরা খুবই সম্ভাবনাময় একটি জেলা। কারণ এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ উৎপাদিত হয়। এসব মাছের শুঁটকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
সৈয়দপুরের বৃহৎ শুঁটকি আড়তের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জানান, প্রতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শুঁটকি মাছ তিনি সংগ্রহ করেন। এসব শুঁটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি সরবরাহ করেন। আমাদের দেশের লোকজন সিলভার কার্প মাছের শুঁটকি খায়।
তাই উত্তরাঞ্চলে এই মাছের শুঁটকির চাহিদা বেশি। তেলাপিয়া মাছের শুঁটকি কাঁকড়ার খাবার হিসেবে চাহিদা বেশি। আর পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পুঁটি মাছের শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে পুটি শুঁটকি রপ্তানি করেন বলে জানান।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিছুর রহমান জানান, মিঠাপানির শুঁটকি মাছ উৎপাদনে খুবই সম্ভাবনাময় জেলা সাতক্ষীরা। বছরে প্রায় দুই লাখ টন সাদা মাছ উৎপাদন হয় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। স্থানীয় আমিষের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
তিনি আরও জানান, এ জেলায় শুঁটকি উৎপাদনেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বছরে একটি সময় ঘেরে ধান চাষ করার জন্য খুবই কম মুল্যে মাছ বিক্রি করেন চাষিরা। এসময় ওই মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি তৈরি করতে পারলে ব্যাপক লাভবান হতে পারেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। তবে জেলায় কি পরিমাণ শুঁটকি মাছ উৎপন্ন হয় তার পরিসংখ্যান জেলা মৎস্য অফিসে নেই বলে জানান তিনি।
Comments (No)