উঠানবাড়ির লুচি–আলুর দমে জান্নাতের ঘুরে দাঁড়ানো অভাব পিছু ছাড়ছিল না হুসনে জান্নাতের। কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানে স্বামীর সামান্য বেতনে চলত টানাপোড়েনের সংসার। একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব সময় দুশ্চিন্তা করতেন। জান্নাত ভাবতেন, মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
অন্যের ওপর নির্ভর না হয়ে নিজেকেই স্বাবলম্বী হতে হবে। লেখাপড়া খুব একটা না করলেও ঠিকই উদ্যোক্তা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জান্নাত।
উঠানবাড়ির সত্ত্বাধিকারী হুসনে জান্নাত ও রফিকুল ইসলাম দম্পতি
হুসনে জান্নাতের (৫০) বাড়ি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে নগরের মডার্ন মোড় এলাকায়। থাকেন নিজ বাড়িতে। এক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনে বাহারি পদের খাবারের দোকান দিয়েছেন। তাঁর দোকানের লুচি-আলুর দম স্বাদে অতুলনীয়। বিক্রিও ভালো।
সংসারে অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি জান্নাত। এরপরও এসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। একমাত্র মেয়ে জান্নাতি তাবাসসুম কারমাইকেল কলেজ থেকে ইংরেজিতে সম্মান পাস করেছেন। বিয়েও দিয়েছেন। বর্তমানে সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের উল্টো দিকে পার্ক মোড়ে উঠানবাড়ি নামের একটি খাবারের দোকান। সোমবার সন্ধ্যায় দেখা গেল, লুচি-আলুর দম খেতে মানুষের ভিড়। একটি প্লেটে তিনটি লুচি, অন্য প্লেটে আলুর দম। জান্নাত নিজেই পরিবেশন করছেন। কথা বলারও যেন ফুরসত নেই। তাঁকে সহযোগিতা করছেন স্বামী রফিকুল ইসলাম।
কাজের ফাঁকে হুসনে জান্নাত প্রথম আলোকে বললেন, মানুষের কাছে হাত না পেতে নিজে কিছু করার ইচ্ছা থেকেই দোকান দিয়েছেন। অভাব-কষ্ট থাকলেও কারও কাছে কখনো হাত পাতেননি। ছোটবেলা থেকে রান্নার প্রতি ঝোঁক ছিল। সুন্দর পরিবেশ পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন।
নগরের পার্ক মোড়ে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ার বিনিময়ে একটি রেস্তোরাঁ ভাড়া নিয়েছেন জান্নাত। রেস্তোরাঁটি নিজের মতো করে সাজাতে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে দুই লাখ টাকা ঋণও নেন। ইতিমধ্যে রেস্তোরাঁর লভ্যাংশ দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধও করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ছাড়াও শহর থেকে তাঁর লুচি-আলুর দম খেতে অনেকেই ছুটে যান।
শহরের অন্য কোথাও এ ধরনের খাবার মেলে না। তিনটি লুচি ও আলুর দম ৫০ টাকা। জান্নাতের দোকানে ৩৩ পদের খাবার পাওয়া যায়। ১০ টাকা থেকে ২০ টাকার মধ্যে আলুভর্তা, বাদামভর্তা, মাছভর্তা ও ডিমভর্তাও মেলে। এ অঞ্চলের জনপ্রিয় স্বাদের শিদলও মেলে।
রংপুর নগরের পার্ক মোড়ের উঠানবাড়ির হুসনে জান্নাত ও রফিকুল ইসলাম দম্পতির বানানো লুচি ও আলুর দমের স্বাদ অনন্য
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা এমন অনেক শিক্ষার্থী উঠানবাড়ির নিয়মিত ক্রেতা। প্রাক্তন শিক্ষার্থী রওনক জাহান বলেন, একটু ভিন্ন স্বাদ পেতে প্রায় লুচি, আলুর দম খাওয়া হয়। দাম খুব একটা বেশি নয়। স্বাদেও অতুলনীয়।
শহর থেকে লুচি, আলুর দম খেতে ছুটে আসেন সাংস্কৃতিক কর্মী ফরহাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, একজন নারী তাঁর নিজের চেষ্টায় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। দিনবদলের সঙ্গে রুচিরও পরিবর্তন হচ্ছে। তাই একটু ভিন্ন স্বাদ নিতে শহরের কোলাহলময় জীবন থেকে উঠানবাড়ির লুচি, আলুর দম খেতে ছুটে আসা।’
হুসনে জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, দোকানে অনেক পদের খাবার থাকলেও লুচি ও আলুর দমের চাহিদা বেশি। সন্ধ্যার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। দুই লাখ টাকা ঋণ নিলেও এক বছরের মধ্যে তা পরিশোধ করেছেন। সেই সঙ্গে দোকান ভাড়াসহ তিনজন কর্মচারীকে বেতনও দিচ্ছেন। এরপরও লাভ ভালো থাকছে।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে এই পর্যায়ে এসেছি। মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছি। এখন স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাজটি করে নিজেকে গর্বিত মনে হয়।’
Comments (No)