মেনি, চাপিলা, চ্যালা, কাইকা, পিয়ালি, গুথুম, বিলের পাঁচমিশালি মাছ, ট্যাংরা, দেশি কই, শোল, পুঁটি, সরপুঁটি, সাতক্ষীরার পারশে, বাতাসি, কাজুলি, পাবদা, তপসে, কাকিলা, গাং বাচা, গুলশা, তারাবাইন, নদীর বেলে, চান্দা, ফলি, টাটকিনি, খল্লা বাটা, লাচো, চিংড়ি, ইলিশ, রুপচাঁদা—তালিকাটা আরও লম্বা। কেউ ছোট মাছ কেটে নিতে চেয়েছেন, তাই এক পাশে চলছে মাছ কাটাকুটি। কেউ কেউ জ্যান্ত মাগুর-কই চেয়েছেন, তাই পলিথিনে পানি দিয়ে লাফানো কই, মাগুর ভরা হচ্ছে। যাঁরা আস্ত মাছ নেবেন, সেগুলোও যাতে নষ্ট না হয়, তাই বড় কার্টনে বরফ দিয়ে প্যাকেট করা হচ্ছে। আর এর ফাঁকেই রাজধানীর উত্তরা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত গাড়ি বা মোটরবাইকে মাছের কার্টন তোলা হচ্ছে। সব কাজ শেষ হতে বেলা প্রায় ১১টা বেজে গেল। কাজ শুরু হয়েছিল সেই ভোর থেকে।
১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় অনলাইন উদ্যোগ রিভার ফিশের অফিসে গিয়ে তাজা মাছ নিয়ে এ হুলুস্থুল কাণ্ড দেখা যায়। বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ঢাকার আশপাশের বিল থেকে মাছ হাতে পাওয়ার পর দ্রুত তা রিভার ফিশের অনলাইনের ক্রেতাদের বাড়িতে পৌঁছানোর জন্যই এত সব আয়োজন
রিভার ফিশের উদ্যোক্তা ফারজানা আকতার জানালেন, অনেক মাছই বিলুপ্তপ্রায়। তাই ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব, তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হয়। আগের দিন ক্রেতার চাহিদা জানানোর পর বিভিন্ন এলাকার ঘাটে সে চাহিদার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। ফারজানা একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করতেন। সম্প্রতি সেটা ছেড়ে দিয়েছেন।
দেড় বছর ধরে রিভার ফিশের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ফারজানা আকতার বললেন, অনলাইন ব্যবসায় ক্রেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা বেশি জরুরি। পচনশীল পণ্য বলে মাছ নিয়ে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও বেশি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় কোনোভাবেই যাতে ক্রেতার বাড়িতে পচা মাছ না যায়। তারপরও কখনো কোনো ক্রেতা মাছ নিয়ে সন্তুষ্ট না হলে আবার মাছ দিয়ে বা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ক্রেতার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা চালানো হয়। এতে করে একই ক্রেতা বারবার মাছ কিনছেন। রিভার ফিশের পেজে নিবন্ধিত ক্রেতার সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
ফারজানা রিভার ফিশের পাশাপাশি ফেরিওয়ালা ঢাকা নামের আরেকটি অনলাইন উদ্যোগ চালান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাছের ক্রেতারাই ফেরিওয়ালার কাছ থেকে শুকনা মিষ্টি মরিচ, শুঁটকি, সরিষার তেল, নিজেদের বানানো গুঁড়া মসলা, চালসহ বিভিন্ন পণ্য কিনছেন। সামনে এ উদ্যোগের সঙ্গে টাটটা সবজিও যুক্ত হবে।
ফারজানা মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে রিভার ফিশের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ব্যবসা থেকে লাভের অংশ অন্য খাতে ব্যবহার করেননি। এভাবেই ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে। এখন দিনে গড়ে প্রায় দুই লাখ টাকার মাছ বিক্রি করছেন। ১৫ জন স্থায়ী কর্মী দুই শিফটে কাজ করছেন। মাছ কাটাকুটির জন্য তিনজন নারী কাজ করছেন। নিয়মিত বাইক রাইডাররা পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খাতে মাসে খরচ সাড়ে তিন লাখ টাকা।
অনেক ক্রেতা ফোন করে নারীকণ্ঠ শুনেই ফোন রেখে দেন। একদিন এক ক্রেতা বলেই ফেলেন, মাইয়্যা মানুষ মাছ বেচে, এইটা আবার কেমুন কথা। আবার অনেকে ফোনেই মাছ চিনব কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে অনেকে নারী হয়ে মাছ নিয়ে ব্যবসা করছি বলে বেশ উৎসাহও দেন।
ফারজানা, উদ্যোক্তা, রিভার ফিশ
ফারজানা বললেন, রিভার ফিশ থেকে নিজে ৫০ হাজার টাকা বেতন নেন। এ ছাড়া ব্যবসার লাভ থেকেই মোটরবাইক, গাড়ি কেনাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করছেন।
রিভার ফিশের অফিসে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে বেলা ১১টা পর্যন্ত দেখা গেল মাছ নিয়ে ফারজানা ও অন্যদের দম ফেলার সময় নেই। সেদিন ১৩০ কেজির বেশি মাছ রাজধানীর বিভিন্ন ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছানো হয়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তিন নারী ১১ কেজি ছোট মাছ কেটে ধুয়ে দেন। ফারজানা হিসাব মেলাতে মেলাতে বললেন, এক ক্রেতা ৩২ হাজার টাকার মাছ নিয়েছেন। অন্যদের মধ্যেও কেউ ১১ হাজার, কেউ ১০ হাজার আবার পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী কেউ অল্প পরিমাণে মাছ নিয়েছেন। সেদিন শুক্রবার ছোট-বড় সব মিলে মোট ৩৫টি অর্ডার পেয়েছিলেন।
বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় মাছ নিয়ে ফারজানা শোনালেন এক ভিন্ন গল্প। বললেন, ছেলে বিদেশ থাকেন। তিনি মায়ের মুখে অনেক মাছের নাম শুনেছেন, যা নিজে তেমন একটা চেনেন না। রিভার ফিশের পেজে সেই মাছের নাম দেখে তিনি ঠিক করেছেন মাকে মাছ গিফট করবেন। তবে শর্ত থাকে মা যেন আগে থেকে কিছু জানতে না পারেন। রিভার ফিশের কর্মীরা সে অনুযায়ী প্যাকেট সাজিয়ে ওই মাকে গিফট পাঠিয়ে দেন। শান্তি মিশনে থাকা এক নারী শ্বশুরবাড়িতেও মাছ পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্নজনের বাসায় একটু ব্যতিক্রমী মাছ পাঠানোরও অর্ডার পান।
ফারজানা বললেন, ‘অনেক ক্রেতা ফোন করে নারীকণ্ঠ শুনেই ফোন রেখে দেন। একদিন এক ক্রেতা বলেই ফেলেন, মাইয়্যা মানুষ মাছ বেচে, এইটা আবার কেমুন কথা। আবার অনেকে ফোনেই মাছ চিনব কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে অনেকে নারী হয়ে মাছ নিয়ে ব্যবসা করছি বলে বেশ উৎসাহও দেন।’
ফারজানা মাছের ব্যবসায় তাড়াহুড়া করেননি। সবকিছু শিখে কাজ করছেন। তাই তো তাজা মাছের এই উদ্যোগ এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে তিনি সন্তুষ্ট।
Comments (No)