২৫০ নারীর কর্মসংস্থান করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন/Sabina Yasmin has given employment to 250 women 2023 প্রতিটি ব্যক্তির সফলতার পিছনে থাকেন তিনি নিজেই। কারণ, তার ইচ্ছাশক্তি, লক্ষ্য পূরণের বাস্তবিক প্রয়োগ এবং অদম্য মনোবল তাকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। তেমনি একজন নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন।
এক সময় এনজিওতে চাকরি করা এই নারী নিজের ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে সাড়া ফেলেছেন নদীভাঙন ও মঙ্গা কবলিত এলাকা গাইবান্ধায়। ৩৪ বছর বয়সী এই নারী উদ্যোক্তা শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ‘নিরাশা দূরীকরণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (ডিএসডিও)’ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে।
ধানঘরা এলাকার শম্পা ৫ মাস আগে থেকে কাজ শুরু করেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। তার কাজ ঝুট কাপড় থেকে সুতা তৈরি করা। প্রতিদিন ২০-২৫ কেজি সুতা তৈরি করতে পারেন। চুক্তিভিত্তিতে এক কেজি সুতা তৈরি করলে ১০ টাকা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে ৬ ঘণ্টা কাজ করে ২৫০ টাকা পর্যন্ত পান।
স্বামী পরিত্যক্তা অল্প বয়সী নারী বিউট বেগম। আট বছর আগে স্বামী ছেড়ে চলে গেছেন। এক মেয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল তার। ছয় মাস আগে প্রতিবেশী এক নারীর মাধ্যমে এখানে এসে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর এ প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পান তিনি। প্রতিদিন ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা মজুরি পান তিনি। এখন তিনি অনেক ভালো আছেন।
এ রকম শিউলি, আসমা, সুলতানাসহ দুই শতাধিক নারী কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। রাইজিংবিডিকে তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানের কথা প্রতিবেশিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারেন। পরে সেখানে (ডিএসডিও) গিয়ে প্রথমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শেখেন। এরপর সেখানে কাজ শুরু করেন। আয়ের টাকায় সাংসারিক খরচ ছাড়াও বাড়তি টাকা সঞ্চয় করার কথাও জানালেন কেউ কেউ।
আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে গাইবান্ধা শহরতলীর বল্লমঝাড় ইউনিয়নের ধানঘড়া এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, নারীরা কয়েকটি শিফটে কাজ করছেন। প্রতি শিফটে ৮০ জন নারী কাজ করেন।
বর্তমানে পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিতে গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় দিয়ে রঙ-বেরঙের পাপোশ তৈরি প্রকল্পের কাজ চলছে। পাশাপাশি দ্বিতীয় পাইলট প্রকল্প হিসেবে নারীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দুটি কারখানা, একটি বড় সেমিনার এবং প্রশিক্ষণ কক্ষ, দুটি অফিস কক্ষ, স্টোর রুম, স্থায়ী কর্মীদের থাকার কক্ষ, ডাইনিং ও ওয়াসরুম রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য রয়েছে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা।
কারখানায় কেউ ঝুট মাল (গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত কাপড়) বাছাই করছেন, কেউ সেগুলো বিভিন্ন রঙের কাপড় মিলিয়ে সেলাই করছেন তাঁতের উপর। কয়েকজন আবার সুতোসহ বিভিন্ন উপকরণ সবার কাছে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেলাইয়ের খুটখাট শব্দে মুখর চারপাশ।
তাঁতের উপর সেলাইয়ের পর দৃষ্টি নন্দন পাপোশগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি কক্ষে। পাশেই আরেকটি কক্ষে রঙ-বেরঙের (লাল-নীল বিভিন্ন রঙের) সুতা আর কাঁচামাল স্তুপ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কারখানা পরিদর্শনকালে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি জানালেন, ‘সমাজে এমন অনেক নারী এবং গরিব পরিবার আছে, যাদের পক্ষে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
একজন অসহায় নারীকে স্বাবলম্বী করতে পারলে গোটা পরিবারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগকে শুধু অর্থ উপার্জনের মূখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন; আমি মনে করি, কমবেশি লাভ সবাই করবে। কিন্তু আমরা উৎপাদন খরচের থেকে সামান্য কিছু লাভ ধরে পণ্য বিক্রি করছি। যারা কম দামে কিনছেন, তারাও কিছুটা কম দামে বিক্রি করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে ৩০ জন নারী কর্মী দিয়ে শুরু করেছিলাম। প্রায় দুই বছরে এখানে ২৫০ জন নারী কাজ করছেন। তারা সবাই এখন আত্মনির্ভরশীল। চেষ্টা করলেই সম্ভব, আর সেটা প্রমাণ করার জন্যই আমার এই ছোট উদ্যোগ। একজন নারী হিসেবে শুধু সফল গৃহিণী ও মা হিসেবে নয়,
পাশাপাশি নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য। কর্মসংস্থান তৈরি করে একজন নারীকে স্বাবলম্বী করতে পারলে, সেই নারী সংসারে স্বামীকেও সাপোর্ট দিতে পারছে। এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই, এগিয়ে নিতে চাই।’
আপনার সফলতার পিছনে কার অনুপ্রেরণা বেশি— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার এই কাজে আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে আমার স্বামী। আমার কাজকে এগিয়ে নিতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা ছাড়াও প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পাশে না থাকলে আমি হয়ত এত অল্প সময়ে, এত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার সাহসই পেতাম না।’
প্রশিক্ষক ও কারখানা ইনচার্জ আনছারুল ইসলাম রাইজিংবিডি-কে বলেন, প্রতিষ্ঠানের বয়স কেবল দেড় বছর হচ্ছে। এই কারখানায় দরিদ্র নারীদের প্রথমে হাতে-কলমে পাপোশ তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এরপর তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার পাপোশ উৎপাদন হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে ঝুট (পরিত্যক্ত কাপড়ের টুকরো) কাপড় সংগ্রহ করে তাঁতের মাধ্যমে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ডিজাইনের পাপোশ তৈরি করা হয়। ডিজাইন করার পর বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে সেগুলো সেলাই করা হয়।
কয়েকটি ধাপ পার হওয়ার পর একটি পাপোশ বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়। বগুড়া, রংপুরসহ স্থানীয় বাজারে পাপোশ পাইকারি বিক্রি করা হয়। প্রকার ভেদে প্রতিটি পাপোশ ২৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ১২০ টাকায়।
গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রবীন চন্দ্র রায় রাইজিংবিডি-কে বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য মেলার আয়োজন করাসহ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নিয়মিত কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রার শুরুতে নির্বাহী পরিচালকসহ বেশ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এরপর তারা স্থানীয় হতদরিদ্র নারী ও ঢাকা ফেরত গার্মেন্টস কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানেই কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। এটি খুব ভালো উদ্যোগ। একজন পরিশ্রমী ও সফল উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন। তাদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ঋণ দিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিংকেজ করে দিচ্ছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।