Florists in the fight to retain the market of 1500 crore rupees
১৫০০ কোটি টাকার বাজার ধরে রাখার লড়াইয়ে ফুল ব্যবসায়ীরা/Florists in the fight to retain the market of 1500 crore rupees শীতপ্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। এই ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পূর্বখণ্ড গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন। সারি সারি ফুলের বাগানে ফুটেছে সাদা, লাল, হলুদ ও বেগুনি টিউলিপ।
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা,/খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি,/দুটি যদি জোটে অর্ধেক তার,/ফুল কিনিও হে অনুরাগী। ’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার এই আহ্বান নিশ্চয় ফুলের প্রতি কবির অনুরাগ থেকে। তবে এখন সত্যি সত্যি সামাজিক অনুষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফুলের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে বাড়ছে ফুলের চাষ এবং ব্যবসাও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২ হাজার টনের বেশি ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার রয়েছে। আর ফুল প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত সহশিল্পের (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) ব্যবসা ধরলে এই বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার।
একসময় দেশে শুধু গাঁদা, গোলাপ ও রজনীগন্ধা চাষ করা হলেও এখন ১৫-১৬ ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে।
গত দু-তিন বছরে দেশে নতুন আরো তিন ধরনের ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। একসময় এই ফুল বিদেশ থেকে আমদানি হতো। তবে এ খাতকে এতটা পথ এগিয়ে নিয়ে আসতে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পার করতে হয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, দেশের ফুল এখন রপ্তানি বাজার ধরার অপেক্ষায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি ও ফুল চাষি আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা ২০১৭-১৮ সালে একটি জরিপ করেছিলাম। ওই সময়ের হিসাব, দেশে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারির আগে এই বাজার আরো অন্তত ১০০ কোটি টাকায় সম্প্রসারিত হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির এই সময়ে আমরা টিকে থাকার লড়াই করছি। একদিকে সামাজিক অনুষ্ঠান কম, অন্যদিকে বাড়ছে প্লাস্টিক ফুলের ব্যবহার।
ফলে কাঁচা ফুলের বাজার ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার মাঝেমধ্যে ফুলে নানা ধরনের জীবাণু আক্রমণ করে। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা, বর্তমানে ফুলের বাজার আগের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছে।’
সোসাইটির হিসাবে, বাণিজ্যিকভাবে প্রথম ফুল চাষ শুরু হয় যশোরের গদখালীতে। বর্তমানে ২০ হাজার কৃষক ২৫টি জেলায় ছয় হাজার হেক্টর জমিতে নানা জাতের ফুল চাষ করছেন। এই খাতে বর্তমানে ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।
ফুলের মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি পূরণ করছেন যশোর ও ঝিনাইদহের চাষিরা। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা ওই দুই এলাকা থেকে ফুল সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া ঢাকার পাশে সাভারে ক্রমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফুল চাষ। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বছরে সেখানে ৩০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয় গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস ও জারবেরা প্রজাতির ফুল। দেশের অভ্যন্তরীণ ফুলের বাজারে প্রতিবছর সাভার এলাকা থেকে ২৫-৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়।
এখন পর্যন্ত আট ধরনের ফুলের উৎপাদন হিসাব রাখে বিবিএস। তাদের হিসাবে, গত অর্থবছর দেশে ৩২ হাজার ১২০ টন ফুল উৎপাদিত হয়েছে। এই উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। এ সময় তিন হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়।
রাজধানীর বাজারে ১৬ ধরনের ফুল
রাজধানীর বাজারে ১৬ ধরনের ফুল পাওয়া যায়। এর মধ্যে সর্বাধিক বিক্রি হয় গোলাপ, রজনীগন্ধ্যা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকা ও বেলি। এর পরেই চেরি, কসমস, জারবেরা, কেলেন্ডোলা, গাজরা (চায়না বেলি), অস্টার, কিচেন টিমাস, টিউলিপ, চায়না গোলাপ ও লিলিয়াম বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফুলের বাজারে যোগ হয়েছে তিনটি নতুন ফুল। টিউলিপ, চায়না গোলাপ ও লিলিয়াম। দাম বেশি হওয়ায় শৌখিন মানুষই কেবল এসব ফুল কেনে। একটি টিউলিপের খুচরা দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা, লিলিয়াম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, চায়না গোলাপ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
শাহবাগের অনন্যা পুষ্প বিতানের মালিক লোকমান বলেন, ‘করোনার কারণে বর্তমানে বড় অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফুলের বেচাবিক্রি কম। বাজার টিকে আছে খুচরা বিক্রির ওপর। শৌখিন মানুষ ফুল কেনে। চাষি ও ব্যবসায়ীরা ডিসেম্বর থেকে মার্চ—এই সময়টাকে ব্যবসার মূল মৌসুম বলেন। ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি- এসব দিনে ফুলের দাম কিছুটা বাড়লেও অন্য সময় দাম বেশি থাকে না। ’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্যোগ
সংস্থাটির মহাপরিচালক আব্দুল গাফ্ফার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার গাবতলীতে ফুলের বড় বাজার তৈরি করা হয়েছে। ফুল উৎপাদনের হাব যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সাভার-গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি অ্যাসেম্বল সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। যেখানে কৃষক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জাতের ফুল বাছাই, মোড়কীকরণ ইত্যাদি করতে পারবেন।
উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানির চেষ্টাও করছি আমরা। এর জন্য ফুল চাষিদের ডাটাবেইস তৈরি করা হয়েছে। যাতে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন ফুল তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। ’ তিনি জানান, যশোরে একটি কোল্ডস্টোরেজ তৈরি হচ্ছে। ফুলের পচন রোধ করে যা চাষিদের রক্ষা করবে।
করোনায় দুশ্চিন্তায় চাষিরা
টানা দুই বছর করোনার ক্ষতিতে আছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তার পরও যশোরের কৃষকরা আশায় বুক বেঁধে আছেন একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব নিয়ে।
ঝিকরগাছার গদখালীর ফুল চাষি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাসচারেক পরিচর্যায় দেড় বিঘা জমিতে গোলাপ, ১২ কাঠা জমিতে জারবেরা ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুল চাষ করেছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের আগমুহূর্তে পর্যন্ত এসব ফুল বিক্রি করে গত দুই বছরের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে চাই।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত নভেম্বর থেকে ফুল বেচাকেনা শুরু করেছি। ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিবসে বেশি দাম ছিল। দুই লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি। আশা করছি, সামনের দিবসে সঠিক দামে ফুলগুলো বিক্রি করতে পারলে আট লাখ টাকার ঋণ শোধ করতে পারব।’
কাঁচা ও প্লাস্টিক ফুল আমদানি
দেশের ফুলের বাজার রক্ষায় এবং এ খাতের প্রসারে বিদেশ থেকে কাঁচা ও প্লাস্টিক ফুল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি শ্রী বাবুল প্রসাদ বলেন,
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন ফুল রপ্তানির মাধ্যমে তাদের রাজস্ব আয় করে, ঠিক সে সময় বিদেশ থেকে কাঁচা ও প্লাস্টিক ফুল আমদানির ফলে আমাদের দেশের ফুল ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চীন, থাইল্যান্ড, ভারত থেকে কাঁচা ও প্লাস্টিক ফুল আমদানি করছে অনেকে। এতে আমারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’