After earning 8 lakhs in two months, now it is expected to sell crores of taka
দুই মাসে ৮ লাখ আয়ের পর এবার কোটি টাকা বিক্রির আশা/After earning 8 lakhs in two months, now it is expected to sell crores of taka হিমালয়কন্যাখ্যাত শীতপ্রবণ জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সুবাস ছড়াচ্ছে টিউলিপ ফুল। উপজেলার দর্জিপাড়ায় বৃহৎ পরিসরে চাষ হয়েছে এই ফুল। স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে বাহারি জাতের টিউলিপ। গত বছর দুই মাসে আট লাখ আয়ের পর এবার কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন চাষি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
গ্রামীণ নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও স্বাবলম্বী করার জন্য টিউলিপ চাষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গত বছর টিউলিপ চাষ করে আট নারী ৬৫ হাজার টাকা করে আয় করেছেন। এবার আরও বেশি লাভের আশায় দুই একর জমিতে ২০ নারী উদ্যোক্তা টিউলিপ চাষ করেছেন। চলতি মৌসুমে কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন তারা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) টিউলিপ উৎপাদনের এই উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গত বছর উপজেলায় পরীক্ষামূলক টিউলিপ চাষ হয়েছিল। এবার কৃষাণীরা দ্বিতীয়বারের মতো টিউলিপ চাষ করে সফল হয়েছেন। কারণ শীতপ্রধান দেশে টিউলিপ দেখা গেলেও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এটি তেমন দেখা যায় না। অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছেন এসব উদ্যোক্তা।
বর্তমানে একেকটি টিউলিপ ১০০ টাকা বিক্রি করছেন। পাশাপাশি বাগানে ক্ষুদ্র পরিসরে বিনোদন পার্ক তৈরি করে পর্যটক ও ফুলপ্রেমীদের জন্য প্রবেশ ফি চালু করেছেন। এতে বাড়তি আয় হচ্ছে তাদের। আগামীতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হতে পারে টিউলিপ।
কৃষাণীরা জানিয়েছেন, দর্জিপাড়া গ্রামের ২০ নারী দুই একর জমিতে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কাণ্ড) রোপণ করেন। ১০ প্রজাতির এক লাখ টিউলিপের বাল্ব রোপণ করেন তারা। সেগুলো হলো—
অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), ডেনমার্ক (কমলা ছায়া), লালিবেলা (লাল), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), স্ট্রংগোল্ড (হলুদ), জান্টুপিঙ্ক (গোলাপি), হোয়াইট মার্ভেল (সাদা), মিষ্টিকভ্যান ইজক (গোলাপি), হ্যাপি জেনারেশন (সাদা লাল ছায়া) ও গোল্ডেন টিকিট (হলুদ)। এরই মধ্যে ২২ দিনের মাথায় ফুটতে শুরু করেছে মনোমুগ্ধকর টিউলিপ। ১০ প্রজাতির ১০টি রঙের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ফুলই ফুটেছে সারিবদ্ধভাবে। এখন বাগানজুড়ে সুবাস ছড়াচ্ছে এসব ফুল।
দর্জিপাড়ার টিউলিপ বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, সূর্যের আলো আর তাপ নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ শেডের (ছাউনি) নিচে সারি সারি ফুটেছে টিউলিপ ফুল। দর্শনার্থীদের কেউ ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ ছবি তুলছেন।
কৃষাণী ও দর্শনার্থীরা জানিয়েছেন, ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে টিউলিপ বাগানে ঢুকছেন প্রত্যেক দর্শনার্থী। তাদের সুবিধার্থে বাগানের পাশে ‘হোটেল টিউলিপ’ নামে একটি রেস্তোরাঁ স্থাপন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। যেখানে ফুল দেখতে আসা মানুষ খেতে পারছেন। সেইসঙ্গে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের অবস্থানের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেস্তোরাঁয় নানা ধরনের স্থানীয় খাবারের ব্যবস্থা আছে।
গত বছর পাঁচ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক টিউলিপ চাষ করেছিলেন বলে জানালেন টিউলিপ চাষি ও উদ্যোক্তা সুমি আক্তার। তিনি বলেন, ‘গতবার বেশ ভালো ফুল হয়েছিল। ৬৫ হাজার টাকা আয় করেছি। এবার ১০ শতক জমিতে চাষ করেছি। আশা করছি, লাভের পরিমাণ বাড়বে। একেকটি ফুলের স্টিক ১০০ টাকা বিক্রি করছি। একেকটি টবসহ ফুল ১৫০ টাকা বিক্রি করছি।’
টিউলিপ চাষি মুক্তা পারভীন বলেন, ‘আগেরবার প্রশিক্ষণ পাইনি। এবার প্রশিক্ষণ পেয়েছি। চাষাবাদ হাতেকলমে শেখানো হয়েছে। ফলে এবার ফুলের উৎপাদন ও সৌন্দর্য ভালো হয়েছে। আশা করছি, এবার আয় বেশি হবে।’
গতবার ফুল বিক্রি করতে একটু সমস্যা হয়েছিল জানিয়ে মুক্তা পারভীন আরও বলেন, ‘এবার ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফুল বিক্রি করতে পারছি। বাগানে প্রতিটি ফুল ১০০ টাকা বিক্রি করছি।’
এদিকে, দর্জিপাড়ায় টিউলিপের বাগানে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। নানা রঙের ফুল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন তারা। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে টিউলিপ বাগান দেখতে এসেছেন। তাদের কেউ কেউ সেলফি তুলছেন, আবার কেউ ফুল কিনে বাড়ি ফিরছেন। দু’একজন চারাসহ ফুলের টব কিনেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে পরিবারের সঙ্গে টিউলিপ বাগান দেখতে এসেছেন সাফিন ও সিপ্রা। তারা জানিয়েছেন, সব মানুষের কাছে ফুলের আবেদন চিরন্তন। আগে কখনও টিউলিপ ছুঁয়ে দেখা হয়নি। ফেসবুকে ছবি দেখে বাগান দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এজন্য চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন। বাগান ও ফুলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তারা।
দিনাজপুর শহর থেকে বাগান দেখতে আসা শাহেদ সুফি বলেন, ‘অনেকদিন ধরে শুনছি তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ চাষ হচ্ছে। এজন্য সপরিবারে বাগান দেখতে এলাম। অনেক বড় বাগান। অনেক ফুলের সমাহার। সারি সারি ফুলের সৌন্দর্য দেখে অসম্ভব ভালো লেগেছে আমাদের।’
শিশুস্বর্গ ফাউন্ডেশন তেঁতুলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কবির আকন্দ বলেন, ‘বিদেশি ফুল টিউলিপ চাষ করে সফল হয়েছেন তেঁতুলিয়ার নারীরা। এই ফুল চাষ অর্থনীতির পাশাপাশি নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। সেইসঙ্গে পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টিউলিপ ফুল সবসময় শীতপ্রধান দেশে চাষ হয়। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এটি তেমন দেখা যায় না। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল ধরা হয়।
এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা হলে প্রাপ্তবয়সের আগে মানসম্মত ফুল নাও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে এবং ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত টিউলিপ ফুল স্থায়ী হয়। আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় এই ফুল চাষ হচ্ছে তেঁতুলিয়ায়।
নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে এবার ৫৫ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানালেন ইএসডিও প্রকল্পের উপ-সমন্বয়ক মো. আইনুল হক। তিনি বলেন, ‘গত বছরের পাইলট প্রকল্প সফল হওয়ায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো বাণিজ্যিকভাবে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
শেড, নেট, রাসায়নিক সার, জৈবসার, কীটনাশক ও শ্রমের মূল্য মিলে দুই একর জমিতে এই পর্যন্ত প্রায় ৮০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এসব ফুল বিক্রির জন্য ইতোমধ্যে ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমরা। আশা করছি, এবার এক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে তেঁতুলিয়ায় প্রথমবারের মতো পাইলট প্রকল্প হিসেবে উপজেলার শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আট নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে ৪০ শতক জমিতে ছয় প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল চাষ করা হয়েছিল। গত বছরের ১ জানুয়ারি টিউলিপ বাল্ব রোপণের ২৩ দিনের মাথায় ফুল ফুটতে শুরু করেছিল। ওই সময় নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ টাকা।’
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, ‘টিউলিপ ফুল চাষে দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও তেঁতুলিয়ার অবস্থান সম্প্রসারিত হবে। ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার লক্ষ্যে তেঁতুলিয়ায় পর্যটকদের জন্য আবাসন ও রেস্তোরাঁ চালু করা হয়েছে।’
ইএসডিও প্রকল্পের পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার বলেন, ‘দেশে ফুলের বাজার প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। টিউলিপ ফুল বাজারজাত করে কৃষকরা দ্রুত লাভবান হচ্ছেন। সাধারণত আমরা যে ক্ষেতে খাদ্য উৎপাদন করি, সে ক্ষেতেই টিউলিপ চাষ হয়। একই জমিতে অন্য কৃষি সঠিক সময়ে উৎপাদন হয়। দ্রুত ফুল আসায় চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটে না।’
এবার কোটি টাকার বেশি টিউলিপ ফুল বিক্রি হবে জানিয়ে সেলিমা আখতার বলেন, ‘এবার ফুল থেকে ২০ লাখের বেশি টাকা লাভের আশা করছি। গত বছর ৩২ লাখ টাকা খরচে ৪০ শতক জমিতে ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল ১০০ টাকা হারে বিক্রি করে দুই মাসে আট লাখ টাকা আয় হয়েছিল।’
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সিনিয়র মহা-ব্যবস্থাপক ড. আকন্দ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবার টিউলিপ চাষে জমির পরিমাণ ও কৃষক-কৃষাণীর সংখ্যা বেড়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এই ফুলের বাল্ব আমদানি করতে না হয়, সেজন্য যশোর ও সাভারে বীজ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা।’
জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. মাসুম আলী বলেন, ‘হিমালয়কন্যা খ্যাত তেঁতুলিয়ার পর্যটন আরও একধাপ এগিয়ে নেবে টিউলিপ। এরই মধ্যে এই ফুল চাষ করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সামনে এই ফুলের চাষ আরও বাড়বে বলে আশা করছি।’
জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক অনিরুদ্ধ কুমার রায় বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে তেঁতুলিয়ার বুকে একখণ্ড নেদারল্যান্ডস। কারণ টিউলিপ মূলত নেদারল্যান্ডসের ফুল। এখন দর্জিপাড়ায় নানা রঙের টিউলিপ ফুল দেখে মন শীতল হয়ে যায় সবার। নিজ চোখে না দেখলে আসলে এর সৌন্দর্য বর্ণনা করা যাবে না।’
তেঁতুলিয়ার আবহাওয়া ও মাটি টিউলিপ চাষের উপযোগী হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে বলে জানালেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘এখানে টিউলিপ চাষ পর্যটনের নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসছেন, এটি আরও সম্প্রসারিত হবে।’