ই-কমার্স কি? কিভাবে ই-কমার্স শুরু করবো? অনলাইন ইনকাম বলতে আমরা যে যে বিষয়কে বুঝি তাদের মধ্যে ই-কমার্স অন্যতম। ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই ইলেকট্রনিক বিজনেস চালু হয়। তবে সে সময় এত ব্যাপকভাবে শুরু না হলেও ২০০০ সালের পর থেকে ই-কমার্স সেক্টরে অভাবনীয় উন্নতি হতে শুরু করে। বাংলাদেশে ছোট বড় আকারে অনেকগুলো অনলাইন বিজনেস প্রচলিত আছে যার কল্যাণে প্রান্তিক এলাকার মানুষ অনলাইনে পণ্য অর্ডার করে ঘরে বসেই সেই পণ্য পাচ্ছে। ই-কমার্স কি, কীভাবে কাজ করে এবং এই বিজনেস শুরু করার বিষয়ে বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
ই-কমার্স কি?
ই-কমার্স এর পূর্ণরূপ ইলেকট্রনিক কমার্স। ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও অর্থ আদান-প্রদান করাকে ই বাণিজ্য বা ই-কমার্স বলা হয়। গতানুগতিক ধারায় আমরা দেখে আসছি যে মানুষ বাজারে গিয়ে কেনা কাটা করে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাইরে গিয়ে কেনাকাটার ধারণা পালটে যাচ্ছে।
ই-কমার্স বিজনেসের প্রসারের মাধ্যমে এখন ঘরে বসেই যে কোন পণ্য বা সেবা অনলাইনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে। পণ্য সরাসরি আমাদের দরজার সামনে হোম ডেলিভারি হয়ে আসছে। এতে জীবন-যাপন অনেক সহজ হয়ে গেছে।
ই-বিজনেস পরিচালিত হয় বিজনেস টু বিজনেস, বিজনেস টু কাস্টমার ও কাস্টমার টু কাস্টমার পদ্ধতি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এই ব্যবসায় সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার মধ্যকার লেনদেন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়।
বর্তমান সময়ের বহুল পরিচিত ওয়েবসাইট দারাজ একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। একজন মানুষের জীবনে যে যে জিনিস প্রয়োজন তার সব কিছু দারাজে পাওয়া যায়। একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইটে বিভিন্ন প্রকারের পণ্য থাকে এবং সেগুলো পছন্দ করে অনলাইনে কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা থাকে।
পছন্দের পণ্য কেনার পর অনলাইনেই উক্ত পণ্যের দাম পরিশোধ করার সিস্টেম আছে যা ওয়েবসাইটে সেটআপ ও কনফিগার করা থাকে। পেমেন্ট করা হয়ে গেলে ডেলিভারি লোকেশন দিতে হয় যাতে পণ্যটি আপনার বাসায় পৌঁছাতে পারে।
মোটকথা, ঘরে বসে অনলাইনে কেনা কাটা করার জন্য তৈরি করা ওয়েবসাইটকে ই-কমার্স বা ইলেক্ট্রনিক কমার্স বলা হয়।
ই-কমার্স কিভাবে কাজ করে?
ই-কমার্স একটি বিজনেস মডেল হিসেবে কাজ করে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা আছে যা এই বিজনেস মডেলকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। আমরা আগেই জেনেছি যে ই-কমার্স হলো একটি অনলাইন বিজনেস। অর্থাৎ এখানে সকল প্রকার লেনদেন অনলাইনে হয়ে থাকে।
যাইহোক, অনলাইনে ই-কমার্স বিজনেস প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন পরবে একটি ওয়েবসাইটের। কারণ গতানুগতিক বিজনেসে একটি দোকান বা সুপারশপ হলো পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করার জায়গা। অন্যদিকে, অনলাইনে ওয়েবসাইট হলো দোকান বা সুপারশপ যেখানে সব ধরনের পণ্য বিক্রি করার জন্য প্রদর্শিত করা হয়।
ওয়েবসাইটে ক্যাটাগরির উপর নির্ভর করে পণ্য যোগ করা হয়। প্রতিটি পণ্যের সাথে উক্ত প্রোডাক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া থাকে যাতে কাস্টমার মনে করে নিজে হাতে পণ্য কিনছে। এছাড়া সেখানে প্রোডাক্টের ভালো এবং মন্দ সবকিছু উল্লেখ করা থাকে। সব তথ্য সাজিয়ে দেওয়ার পর সেখানে বিক্রয় মূল্য যোগ করে দেওয়া হয়।
এতে সম্ভাবনাময় ক্রেতা প্রোডাক্ট এর কোয়ালিটি বিচার করে উল্লেখ করা দামে ক্রয় করতে পারে। পছন্দের পণ্য কেনার জন্য উক্ত পেজে একটি “Add to Cart” বাটুন থাকে যা সরাসরি পেমেন্ট পেজে নিয়ে যায়। এই পেজে পেমেন্ট করার জন্য সব ধরনের তথ্য ও অপশন দেওয়া থাকে। পেমেন্ট প্রোসেসিং করার সময় ডেলিভারি অ্যাড্রেস দিয়ে দিতে হয়, এতে কুরিয়ার বা ডেলিভারি সার্ভিস উক্ত পণ্য আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে।
তো, ই-কমার্স বিজনেস মডেল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তার মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। যে বন্ধন নিশ্চিত করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডুপ্লিকেট বা নষ্ট পণ্য সরবরাহ করবে না এবং ভোক্তা উক্ত পণ্য পাওয়ার জন্য অগ্রিম পেমেন্ট করবে।
কিভাবে ই-কমার্স শুরু করবো?
ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার আগে আপনাকে এই বিজনেস মডেল কি এবং কীভাবে কাজ করে তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। চলুন একটি ই-কমার্স বিজনেস কীভাবে শুরু করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
পরিকল্পনাঃ বলা হয়ে থাকে, সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে কোন কাজ ৫০% হয়ে যায়। ই-কমার্স যেহেতু একটি ব্যবসা সেহেতু তা সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা করতে হবে। এই পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে টার্গেটেড অডিয়েন্স, নির্দিষ্ট এলাকা, কি কি প্রোডাক্ট থাকবে, কত পরিমাণ পণ্য স্টকে থাকবে, ওয়ারহাউস সেটআপ, ওয়েবসাইট তৈরি, মার্কেটিং, আফটার সেলস সার্ভিস ইত্যাদি সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়।
আপনি বিজনেস শুরু করার পূর্বে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে সঠিক প্ল্যান দ্বার করাতে পারলে কম্পিটিশনে অনেক এগিয়ে যেতে পারবেন। শূন্য থেকে বিজনেস দাড় করাতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে নয় রণকৌশল দিয়ে জিততে হয়।
ইনভেস্টমেন্ট প্রক্রিয়াকরণঃ বিজনেস করার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট। মূলধন ছাড়া কখনই একটি বিজনেস দাড় করানো যায় না। ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার আগে মূলধন ও বিনিয়োগ বণ্টন বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করে নিতে হবে।
শুরুতে খুব অল্প পরিমাণ মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা বড় হবে। তখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে ইনভেস্টমেন্ট আসা শুরু হবে। সঠিক ভাবে এসব বিনিয়োগ বণ্টন করতে না পারলে ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
অন্যদিকে, ইনভেস্টমেন্ট সঠিক ভাবে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারলে অল্প সময়ে কম্পিটিটরদের থেকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। যা অনলাইন বিজনেসের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। বর্তমান সময়ে অনেক নামি-দামি দেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অপরিকল্পিতভাবে ইনভেস্টমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ করার কারণে ব্যবসায় লোকসান করছে। তারপর একটি সময় ইনভেস্টরদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করছে। অতএব সঠিক বিনিয়োগ ও মূলধন প্রক্রিয়াকরণ না করতে পারলে ই-কমার্স বিজনেসে সফল হওয়া যাবে না।
ওয়েবসাইট তৈরিঃ পূর্ব-প্রস্তুতি শেষ হলে নজর দিতে হবে আধুনিক ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরির দিকে। বর্তমানে অনেক ডেভেলপমেন্ট স্টার্ট-আপ কোম্পানি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করার সার্ভিস দিয়ে থাকে। আপনি সেগুলো থেকে সার্ভিস নিয়ে অথবা পার্সোনাল ডেভেলপার হায়ার করে ওয়েবসাইট তৈরি করে নিতে পারবেন।
ওয়েবসাইট তৈরি করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন উন্নতমানের হোস্টিং কনফিগারেশন এর দিকে। কারণ একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইটে অনেক দাতা থাকে এবং অনেক ভিজিটর ব্রাউজ করতে আসে। কমদামি বা দুর্বল কনফিগারেশনের হোস্টিং হলে ওয়েবসাইট ধীরে কাজ করবে অথবা কাজ করা বন্ধ করে দেবে যা অনলাইন বিজনেসের জন্য ক্ষতিকর।
ডেভেলপারকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিবেন যাতে ওয়েবসাইটে সাম্প্রতিক সময়ের সকল প্রয়োজনীয় ফিচার থাকে। এতে ক্রেতা খুব সহজেই আপনার ওয়েবসাইট পছন্দ করবে এবং আপনার সেল বাড়বে।
কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণঃ আপনি যে যে প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন সেগুলো যাতে ভালো কোয়ালিটির হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। সাধারণ কাস্টমার যখন অনলাইনে কোন পণ্য ক্রয় করে তখন তার মনের ভেতরে গুণাগুন নিয়ে সন্দেহ কাজ করে।
আপনি যখন ভালো কোয়ালিটির পণ্য সাপ্লাই করবেন তখন ক্রেতার মনের সন্দেহ দূর হয়ে যাবে এবং তিনি বারবার আপনার স্টোর থেকে পণ্য কিনবে।
মার্কেটিংঃ অনলাইনে যে কোন বিজনেস সফলতার পেছনে সব থেকে বেশি কাজ করে মার্কেটিং। ইন্টারনেটে মার্কেটিং এর কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের কাছে কোন সার্ভিস বা প্রোডাক্টের চাহিদা তৈরি করার যে প্রক্রিয়া তা হলো মার্কেটিং।
অর্থাৎ আপনার ই-কমার্স বিজনেসকে ইন্টারনেট ব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং ক্রেতার কাছে সহজ লভ্য করার জন্য মার্কেটিং এর কোন জুরি নেই। অতএব, আপনার পুরো ইনভেস্টমেন্টের একটি বড় অংশ অফলাইন এবং অনলাইন মার্কেটিং এর জন্য ব্যয় করতে হবে। অনলাইন মার্কেটিং এর জন্য SEO অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং অফলাইন মার্কেটিং এর জন্য বিভিন্ন কনফারেন্স বা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনঃ বিজনেসের খাতিরে তৈরি করা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড হিসেবে প্রচলিত হয় তখন, যখন তা ক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। অ্যামাজন বা দারাজ কিন্তু একদিনেই আজকের এই অবস্থায় আসেনি। তারা দীর্ঘ সময় ধরে ভালো সার্ভিস এবং পণ্য সাপ্লাই দিয়ে কাস্টমারের বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছে।
ই-কমার্স বিজনেস শুরু করার আগে কীভাবে আপনিও এই বিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। না হলে এই অনলাইন বিজনেসকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
ই-বিজনেস একটি চিরন্তন ব্যাবসায়িক মডেল। কারণ বর্তমানে যে হারে ই-কমার্স ব্যবসার উন্নয়ন হচ্ছে তাতে সেদিন আর বেশি দেরি নেই যখন মানুষ সশরীরে মার্কেটে যাওয়া বাদ দেবে এবং ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার করবে।
Comments (No)