নারী উদ্যোক্তারা হতে পারেন অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি বাংলাদেশের জিডিপিতে বর্তমান নারীর অবদান ১০ শতাংশ এবং উদ্যোক্তার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করা হলে তাদের জিডিপিতে অবদান হবে ২৫ শতাংশ।
নারীকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কারিগরি ও আর্থিক সুবিধা দিলে পুরুষ সহকর্মীদের থেকে সমাজ অনেক বেশি সুবিধা পায়। একজন নারী সফল উদ্যোক্তা হলে পরিবার নানাভাবে উপকৃত হয় যেমন ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন, পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত, পরিবারের চিকিৎসার খরচ জোগান এবং পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা ভরসার জায়গা খুঁজে পান। এমনটি মনে করেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক।
নারী উদ্যোক্তা ফোরাম – Women Entrepreneurs Forum
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় নারী। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সক্ষম নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রয়েছেন। কেন নারীরা উদ্যোক্তা হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, তা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। গবেষণায় জানতে পারি নারীদের মধ্যে কিছু বাধা আছে যা তাদের এ পথ থেকে বিমুখ করছে।
প্রথমত, নারীদের নিজস্ব সঞ্চয় বলতে কিছু থাকে না যা দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে কোনও ব্যবসা আরম্ভ করতে পারেন। জন্মসূত্রে নারীরা পিতৃ-সম্পদে অধিকার থাকলেও তাদের আয়ত্তে কোন প্রকার স্থায়ী সম্পদ থাকে না। কোন ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে তারা সহজে ঋণ পান না। উপরন্তু তাদের ঋণের নমিনি (গ্রান্টর) হিসেবে বাবা বা ভাই অথবা স্বামীকে প্রয়োজন হয়।
নারী উদ্যোক্তা বিডি/Nari Uddokta BD
নারীদের মধ্যে সব-সময় সফল না হবার ভয় কাজ করে। তাদের সামনে কোন সফল নারী উদ্যোক্তা না থাকায় অথবা তারা কোন নেটওর্য়াকের সাথে যুক্ত না থাকায় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে শক্ত মনোবলের অধিকারী হন না। সাধারণত মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর ঘরে চলে যান। যদি মেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয় এবং স্বামী তার ব্যবসার কর্তৃত্ব ধারণ করেন- অনেক বাবা-মা এ কারণেও মেয়েকে আর্থিক ও মানসিকভাবে ব্যবসায়ী হতে উৎসাহ দেন না।
নারীদের উদ্যোক্তা হতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ এখনও সীমিত। হাতে-কলমে শিক্ষার অভাব নারীদের ব্যবসায়ীক উদ্যোক্তা হবার পরিবর্তে গৃহস্থলির কাজে মনোনিবেশ হবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
সময়ের সাথে নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার অংশগ্রহণের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। যদি আমরা পরিসংখ্যান দেখি বর্তমানে নারী উদ্যোক্তার হার মোট উদ্যোক্তার ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
নারী উদ্যোক্তা কে?
খাদিজা (ছদ্মনাম) দিন মজুর পরিবারের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে। জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবতায় আনতে পরিবার থেকে সমাজের সাথে তিনি অনেক সংগ্রাম করেছেন।
পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন তাকে বিয়ে দেবার জন্য অনেকবার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং প্রতিবারই খাদিজা সবিনয়ে প্রস্তাব ফিরে দিয়ে বাবা-মাকে তার স্বপ্নের কথা বলেছেন। পড়া-লেখা এবং ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন। অনেকের কটূক্তি, আত্মীয়-স্বজনের দূরে সরে যাওয়া, বাবা-মার বিরক্তি খাদিজাকে দমাতে পারেনি।
খাদিজা এখন সফল নারী উদ্যোক্তা। পরিবারে আগের মতো অভাব-অনটন নাই। বাবা-মা এখন খাদিজার ব্যবসার সহযোগী। ছোট ভাই-বোনেরা পড়ালেখা করছে। খাদিজা বিভিন্ন সমাজিক অনুষ্ঠানে এমনকি জাতীয় বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান। নিজ এলাকায় খাদিজা সবার আর্দশ এবং অনেকে তাকে অনুসরণ করে।
আজকের খাদিজা হবার পেছনে পরিবার, সমাজ ছাড়াও তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দিনমজুর পরিবারের সন্তান হওয়ায় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ পেতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ব্যবসা সংক্রান্ত কোন জ্ঞান না থাকায় অন্যের সঙ্গে কটূক্তির ভয়ে আলোচনা কোন সুযোগ পাননি ।
একজন উদ্যোক্তাকে সফল হতে হলে নিজের আত্মবিশ্বাস থাকা জরুরী। খাদিজা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সর্বদা মনে করেন মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা হবার জন্য সুযোগের পাশাপাশি কিছু সম্যসার বিষয় আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়াও সমস্যা হিসেবে প্রথম আসে ব্যবসা শুরুর অর্থায়নের প্রসঙ্গ। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় নারীদের সম্পদের অংশীদারি থাকলেও তা যৎসামান্য দেখা যায়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে (অনেকাংশে পরিবর্তন হচ্ছে) নারীরা স্বামী সংসার নিয়ে গৃহে কাজ করবে। এ ধরনের পরিবেশে নারীরা সবচেয়ে ভীত থাকে যদি ব্যবসা করতে গিয়ে তারা ব্যর্থ হন।
একটি পরিবারে স্বামী এবং স্ত্রীর অবদান অপরিসীম। যদি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্বামী ও স্ত্রীর সমান অংশগ্রহণ থাকে তাহলে পরিবারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হবে। বাংলাদেশের বিশাল নারী জনগোষ্ঠিকে যদি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অর্ন্তভূক্ত করা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বর্তমান অর্জনের চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে বর্তমান নারীর অবদান ১০ শতাংশ এবং উদ্যোক্তার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করা হলে তাদের জিডিপিতে অবদান হবে ২৫ শতাংশ।
নারী উদ্যোক্তাদের সুবিধা হচ্ছে পরিবারকে সময় দিয়ে নিজে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেশে কিছু প্লাটফরম তৈরি হয়েছে এবং বিশেষ করে সরকারের প্রচেষ্টায় কিছু ব্যাংক নারীদের উদ্যোক্তা হবার পেছনে লগ্নি করছে।
নারী উদ্যোক্তা হতে হলে অবশ্যই কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে নিজের ব্যবসা সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা নিরুপন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চলে যে পণ্যের চাহিদা থাকবে দক্ষিণাঞ্চলে উক্ত পণ্যের চাহিদা নাও থাকতে পারে। ক্রেতা সর্ম্পকে ভাল ধারণা রাখতে হবে যেমন তাদের পেশা, আয়, পরিবারের জীবনমান ইত্যাদি। কারণ ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের মান নির্ধারণ করতে হবে।
দেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সরকার অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে নারীর অগ্রগতির জন্য। কিন্তু সরকারকে দেখতে হবে গৃহীত পদক্ষেপের সাথে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক কিনা। যদি প্রত্যাশিত হারে নারীর অংশগ্রহণ না হয় তাহলে খতিয়ে দেখতে হবে কারণগুলো কী এবং তা নিরসনের উপায় বের করতে হবে।
দেশের বেসরকারি সংস্থা সমূহকে নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সমাজ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, বিভিন্ন অ্যালায়েন্স গঠন, ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। সুশীল সমাজকে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের বিকাশের জন্য পথ প্রশস্ত করে দিতে হবে।
দেশের অর্থনীতি বির্নিমাণে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাক এবং অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই আগামীর বাংলাদেশ।
Comments (No)