কৃষিকাজ

কৃষিকাজ হল গাছপালা এবং গবাদি পশু চাষের পদ্ধতি। উপবিষ্ট মানব সভ্যতার উত্থানের বিকাশের চাবিকাঠি ছিল কৃষি, যার ফলে গার্হস্থ্যকৃত প্রজাতির চাষ খাদ্য উদ্বৃত্ত তৈরি করে যা মানুষকে শহরে বসবাস করতে সক্ষম করে। কৃষিকাজের ইতিহাসের সূত্রপাত হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে।

এক ফসলি কৃষি কি?

কৃষির আলোচনায় এক ফসলী চাষ বা এক ফসলী কৃষি বলতে একটি জমিতে প্রতিবারে একই সময়ে মাত্র একটি করে ফসলের প্রজাতি চাষ করার চর্চাকে বোঝায়। একে ইংরেজি পরিভাষায় “মনোকালচার” (ইংরেজি: Monoculture) বা “মনোক্রপিং” (ইংরেজি: Monocropping) বলে।

কৃষিকাজ 1

এক ফসলী চাষ 

কৃষির আলোচনায় এক ফসলী চাষ বা এক ফসলী কৃষি বলতে একটি জমিতে প্রতিবারে একই সময়ে মাত্র একটি করে ফসলের প্রজাতি চাষ করার চর্চাকে বোঝায়। একে ইংরেজি পরিভাষায় “মনোকালচার” (ইংরেজি: Monoculture) বা “মনোক্রপিং” (ইংরেজি: Monocropping) বলে।

এক ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর

ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকেরা একই সঙ্গে এক ফসলি জমিকে দ্বি-ফসলি, তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করছেন। এ ছাড়া যেসব জমি বা জলাশয় কখনও চাষ করা হয়নি, এসব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে।

উপজেলার কৃষকেরা জানান, ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পতিত জমিতে বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন। বিশেষ করে রবিশস্য ও বোরো ধান চাষ হচ্ছে। পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা ও সরকারি প্রণোদনা প্রদান করলে আরও পতিত জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া এক ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করে সবজি ও বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করছেন বলে জানান তারা।

উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ মৌসুমে উপজেলায় বোরো ধান চাষ করা হয়েছে ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর, সরিষা ৮৫ হেক্টর, সবজি ১ হাজার ৩২০ হেক্টর ও আলু ৪৯০ হেক্টর। যা ৫ বছরের ব্যবধানে ২০২১-২২ মৌসুমে ৫৭০ হেক্টর বেড়ে বোরোধান ৪ হাজার ৫১০ হেক্টর চাষ করা হয়।

একই সঙ্গে সরিষা ৩০ হেক্টর বেড়ে ১১৫ হেক্টর, সবজি ২৬০ হেক্টর বেড়ে ১৫৮০ হেক্টর এবং আলু ৩৫ হেক্টর বেড়ে ৫২৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা হচ্ছে। পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর সেচ ব্যবস্থা বাড়ানো হচ্ছে।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা সবজি ও বোরো ধানের প্রতি ঝুঁকছেন। তারা বিভিন্ন পতিত জমিতে সরিষা, আলু, শাকসবজি চাষ করছেন।

এ ছাড়া বোরো ধানের বীজতলার জন্য পতিত জলাশয় প্রস্তুত করছেন। কৃষিতে খরচ বাড়লেও সারা বছর সবজিতে ভাল দাম পাওয়া যায়। এ জন্য পতিত জমিসহ সব জমিতে চাষ বেড়েছে।

কৃষক শামসুল মিয়া বলেন, আমি গত তিন বছর ধরে আমার ১ একর জলাশয়ে বর্ষা মৌসুমে মাছের সাথে ধান আর শুষ্ক মৌসুমে সবজি চাষ করছি। অথচ এ জমি গুলো কয়েক বছর আগেও পতিত ছিল।

কৃষিকাজ 2

কৃষক জহুর মিয়া বলেন, আমি আগে আমার জমিতে শুধু আমন ধান চাষ করতাম। আমন চাষ করে আমার পরিবারের খাদ্যের চাহিদায় ঘাটতি থাকতো। পরে একই জমিতে গত তিন বছর ধরে আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষ করছি। এখন পরিবারের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে ধান বিক্রি করি।

কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জনি খান বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এ উপজেলায় অনেক পতিত জমি চাষের আওতায় এসেছে। পর্যাপ্ত সেচ থাকলে আরও পতিত জমি চাষের আওতায় আসবে। কৃষকরা পতিত জমিতে সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন। বর্তমান সময়ে কৃষকরা অতি সহজে এক ফসলি জমিতে দ্বি-ফসলি, তিন ফসলি ফসল উৎপাদন করছেন।

ফসল উৎপাদন ও শস্যনিবিড়তা

বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশির ভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সব নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা।

জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-২) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব নাগরিকের জন্য খাদ্য জোগানে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।


বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯০ হেক্টর। মোট ফসলি জমি প্রায় ১৭৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর যা জনসংখ্যার তুলনায় কম।

আর তাই কৃষিতে শস্যনিবিড়তা (Cropping Intensity) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি নির্দিষ্ট জমিতে এক বছরে কয়টি ফসল উৎপাদন করা হয় শস্যনিবিড়তা তাই নির্দেশ করে। সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৃত্তিকার গুণাগুণ, সেচ সুবিধাসহ কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ততা,  মালিকের অনুপস্থিতি, অতিরিক্ত জমির মালিকানা, বর্গা চাষ, অকৃষি খাতে উপার্জন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানাবিধ কারণের ওপর জমির শস্যনিবিড়তা হ্রাসবৃদ্ধি নির্ভর করে। মৃত্তিকা পরীক্ষা করে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

দেশব্যাপী কৃষি অঞ্চলগুলোতে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি শস্যবিন্যাস চলমান রয়েছে। চার ফসলি শস্যবিন্যাস মোট ফসলি জমির মধ্যে প্রায় ৬১ হাজার ৮২২ হেক্টর চাষাবাদ হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী   ১৯৭১-৭২ সালে ফসলের নিবিড়তা ছিল ১৫৩.৭৪%। বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ২০৫% (ডিএই ২০২০-২১)।

কৃষিকাজ 3

কৃষি অঞ্চল হিসেবে ফসল নিবিড়তা সবচেয়ে বেশি বগুড়া অঞ্চল ও যশোরে  অঞ্চলে (২৩৬), সবচেয়ে কম স্বাভাবিকভাবেই রাঙ্গামাটি কৃষি অঞ্চলে (১৩৮)। এছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চল যেখানে নদ-নদী খাল-বিলের সংখ্যা বেশি সেসব (যেমন পটুয়াখালী (১৯৬), পিরোজপুর (১৬৫), খুলনা (১৭৬), ঝালকাঠি (১৮৩), সাতক্ষীরা (১৯৮), নোয়াখালী (১৭৩), বাগেরহাট (১৫৪), শরীয়তপুর (১৮৬) এবং বরিশাল (২০২)) জেলায় শস্যনিবিড়তা অপেক্ষাকৃত জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। এক সময়কার প্রবাদ বাক্য “ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল”।

সেই বৃহত্তর বরিশালে অনেক আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে না। অথচ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে কৃষি খানার সংখ্যা সর্বাধিক ৬৬%। এখন বরিশাল নয় বরং উত্তরাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চলকে বাংলাদেশের শস্যভা-ার বলা হয় যেখানে চাষাবাদ হয় মূলত ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দিয়ে।


অনুরূপভাবে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের জেলাগুলোতে বহু আগে থেকেই অনুপস্থিত ভূমি মালিকানার জন্য (Absentee land owner) কৃষি জমিতে সঠিক মাত্রায় চাষাবাদ হচ্ছে না। অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অথবা সাময়িকভাবে পতিত পড়ে থাকে।

পরিস্থিতি বিবেচনায়  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে (Increasing Cropping in Sylhet Region Project) শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। সুনামগঞ্জ, সিলেট এবং  মৌলভীবাজারে ২০১৩-১৪ সালে শস্যনিবিড়তা ছিল যথাক্রমে ১৩০, ১৫১, এবং ১৫০। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০ সালে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে  শস্যনিবিড়তা কিছুটা বেড়ে যথাক্রমে ১৩৭, ১৭৬ এবং ১৮০ তে দাঁড়িয়েছে।

কৃষিকাজ 4

এসব জেলাগুলোতে শস্যনিবিড়তা আরো বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিল্পের মতো উপকরণ, প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলেই ক্রমাগত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে না, একটা পর্যায়ে গিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জমির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ খুব একটা নেই বরং শিল্পায়ন, নগরায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অকৃষি খাতে ভূমি ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় এক শতাংশ হারে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। এটি কৃষির উপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ যা মোকাবিলা করতে হলে জমির পূর্ণ ব্যবহার করা প্রয়োজন।


চলমান কোভিড-১৯সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষির অগ্রযাত্রায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার দুটো বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন; ১) এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না এবং ২) ফসলের বহুমুখীকরণ। সময় এসেছে সুচিন্তিতভাবে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলকে বিভিন্ন ফসলের আওতায় ভাগ করে চাষাবাদের আওতায় এনে  কাক্সিক্ষত মাত্রায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার।

যেহেতু ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল একে বাদ দিয়ে শুধু অন্য ফসলের উন্নয়ন কখনই সময়োপযোগী হবে না। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশে মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা। তাই  বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে অঞ্চলভিত্তিক শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করে যাচ্ছে।

অধিকাংশ চার ফসলি শস্যবিন্যাসগুলোতে দুইটি ধান থাকায় খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।
বাংলাদেশের  কৃষির মৌসুম ৩টি। যথা: ১) রবি মৌসুম; ২) খরিফ-১ মৌসুম; ৩) খরিফ-২ মৌসুম। দেশব্যাপী ১৪ টি কৃষি অঞ্চল রয়েছে। সাধারণত অঞ্চলের কৃষি পরিবেশ যেমন:প্রাকৃতিকরূপ, ভূমিরূপ, সেচ  ও দুর্যোগ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত অঞ্চলভিত্তিক চার ফসলি প্রায় ৭৪টি শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করা হয়েছে।

কৃষিকাজ 5

উদাহরণস্বরূপ, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি কম ব্যবহার হয় সেক্ষেত্রে তিন মৌসুমে চার ফসলের শস্যবিন্যাস মসুর-মুগ-রোপা আউশ- রোপা আমন হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া এ ধরনের শস্যবিন্যাসে মুগডালের পড বা ফল তুলে গাছগুলো মাটির সাতে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং আমন ধানে কম ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তবে মুগডালের গাছ মাটির সাথে মিশানোর ৪-৫ দিন পর আমন ধানের চারা লাগালে বেশি লাভ হয়।

আর মুগডাল চাষে পানির তেমন প্রয়োজন হয় না এবং সঠিক সময় বপন ও রোপণ করা হলে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ২৫-২৮ দিন অবশিষ্ট থেকে যায়। এক কথায় বলা যায়  উৎপাদনে সময় ও খরচ কম হয়।
দেশব্যাপী ১৪টি কৃষি অঞ্চলের মধ্যে রাঙ্গামাটি ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলে চার ফসলি শস্যবিন্যাসে চাষ চলমান রয়েছে। যেমন : খুলনা অঞ্চলে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) আবার এভাবেও হতে পারে খেসারি-ফল বাগান (তরমুজ)-আউশ-রোপা আমন। সিলেটে অঞ্চলে সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি

(গ্রীষ্ম); যশোরে অঞ্চলে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) অথবা সরিষা-বোরো-আউশ-রোপা আমন; ময়মনসিংহ অঞ্চলে একইভাবে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) আবার সবজি (শীত)-বোরো-পাট-রোপা আমন হতে পারে। কুমিল্লা অঞ্চলে সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-তিল (গ্রীষ্ম)-বোনা আমন আবার সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-পাট-রোপা আমন চলমান রয়েছে।

রাজশাহী অঞ্চলে তিল-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন অথবা আলু-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন অথবা সরিষা-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন আবার এমনও হতে পারে গম-ধৈঞ্চা-রোপা আউশ-রোপা আমন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামার প্রবণতা বিদ্যমান বিধায়  সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারিভাবে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি সেচের ব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

ভূউপরিস্থ পানি সেচের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের প্রচেষ্টা জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে।
মানুষের খাদ্যের প্রাথমিক যোগানদাতা কৃষি।  শিল্প বা অন্য কোন সেক্টর থেকে খাদ্যের জোগান পাওয়া গেলেও ঐসব সেক্টর কৃষির উপর নির্ভর না করে মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে পারে না।

তাই কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই। কেউ জমির যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জমির মালিকানা অপরিবর্তিত রেখে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাতে অনুপস্থিত ভূস্বামীদের জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হতে পারে এবং এতে সার্বিকভাবে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে।


কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের পূর্বশর্ত হচ্ছে কৃষিকাজকে লাভজনক এবং আনন্দদায়ক করা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, চাষাবাদ পদ্ধতি আধুনিকীকরণ, নুতন জাত উদ্ভাবন, বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি,-এ সবই আনন্দদানের অনুষঙ্গ।

উৎপাদিত শস্যের গুদামজাত বা বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কৃষকদের মধ্যে সমিতি বা সমবায় সমিতি গড়ে দেয়া যেতে পারে। কর্তিত শস্য এসব সমিতির মাধ্যমে সরকারি সংগ্রহকেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করা গেলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পেতে পারে

জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে         কৃষি মেলা, কৃষক সমাবেশ আরো আকর্ষণীয়  ও প্রতিযোগিতামূলক করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ছাড়াও সিআইপির ন্যায় এআইপি প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। জাতীয়ভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলাপর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ কৃষকদের/কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদানকে স্বীকৃতি প্রদান করা প্রয়োজন।

এক-নজরে-বাংলাদেশ-কৃষি

মোট পরিবার/খানা:৩,৫৫,৩৩,১৮০মোট কৃষি পরিবার/খানা:১,৬৫,৬২,৯৭৪কৃষি বর্হিভূত পরিবার/খানা ১,৮৯,৭০,২৬০মোট আবাদযোগ্য জমি:৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টরমোট সেচকৃত জমি:৭৮.৭৮ লক্ষ হেক্টরআবাদযোগ্য পতিত:৪.৩১ লক্ষ হেক্টরফসলের নিবিড়তা (%):১৯৮%এক ফসলি জমি :২১.১০ লক্ষ হেক্টরদুই ফসলি জমি :৪১.২৫ লক্ষ হেক্টরতিন ফসলি জমি :১৮.৬৬ লক্ষ হেক্টরচার ফসলি জমি ০.১৭ লক্ষ হেক্টরনিট ফসলি জমি:৮১.২৫ লক্ষ হেক্টরমোট ফসলি জমি :১৬০.৫৬ লক্ষ হেক্টরজিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান:১৩.২৯ (২০২০-২১) (p)জিডিপিতে শস্য খাতের অবদান:৭.৩৭  (স্থির মূল্যে) ২০১৭-১৮ (p)কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ২৪.৬৯উৎসঃ কৃষি ডাইরি ২০২২তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)

খাদ্য শস্যের আবাদি জমির পরিমাণ ও উৎপাদন, ২০২০-২১

খাদ্য শস্যআবাদি জমি উৎপাদন
 লক্ষ একরলক্ষ হেক্টর লক্ষ মেট্রিকটন
আউশ৩২.২৩১৩.০৪৯৩২.৮৪৭
আমন১৩৮.৯৫৫৬.২৫৯১৪৪.৩৭৮
বোরো ১২০.৩৫৪৮.৭২৬২০৮.৮৫৩
মোট (চাল)২৯১.৫৪১১৮.০৩৫৩৩৮.০৪
গম ৮.৩৯৫৩.৩৯৯১২.৩৪৩
ভুট্টা১৩.৯৩৮৫.৬৪৩৫৬.৬৩
মোট খাদ্য শস্য (চাল+গম+ভুট্টা)৩১৩.৮৮১২৭.০৮৪৫৫.০৫
তথ্যসূত্র : কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০২২, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর 

একজন কৃষক কী কী কাজ করেন?

কৃষক একজন ব্যক্তিবিশেষ যিনি কৃষিকার্য পেশায় নিয়োজিত থেকে ফসল উৎপাদন করেন। পাশাপাশি তিনি খাবারের উপযোগী করে গৃহপালিত প্রাণী লালন-পালন করেন। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে এ পেশার মাধ্যমে কৃষক মানুষের জন্যে খাদ্য সরবরাহ করে জীবনকে চলমান রেখেছেন।

বিভিন্ন প্রকার কৃষি প্রণালী

মানুষের প্রধান অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ হল কৃষিকাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়ে থাকে। কৃষিকাজের এই বিভিন্নতা নির্ভর করে একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক এবং আর্থসামাজিক পরিবেশের ওপর। কৃষিকাজের পদ্ধতিকে কৃষি প্রণালী বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বা অঞ্চলের কৃষি প্রণালীর শ্রেণিবিভাগ নীচে আলােচনা করা হল一

(১) শস্য-উৎপাদনের পরিমাণ ও বাজার ভিত্তিতে一

  • আদিম জীবিকাসত্তাভিত্তিক কৃষি
  • স্থানান্তর কৃষি,
  • স্থায়ী কৃষি
  • বাণিজ্যিক কৃষি,
  • বাগিচা কৃষি,
  • উদ্যান কৃষি,
  • মিশ্র কৃষি


(২)
কৃষিজমির পরিমাণ এবং জনসংখ্যার তারতম্য ভিত্তিতে一

  • নিবিড় কৃষি,
  • ব্যাপক কৃষি

(৩) আর্দ্রতার তারতম্য ভিত্তিতে一

  • আর্দ্র কৃষি,
  • শুষ্ক কৃষি,
  • সেচ কৃষি

(৪) কৃষিজমি ব্যবহারের পৌনঃপৌনিকতা ভিত্তিতে一

  • এক-ফসলি কৃষি,
  • দো-ফসলি কৃষি,
  • বহু ফসলি কৃষি,
  • ইন্টারক্রপিং,
  • শস্যাবর্তন

৫) ঋতুর তারতম্য ভিত্তিতে一

  • খরিফ কৃষি,
  • রবি কৃষি

(৬) আঞ্চলিক বিশেষীকরণের তারতম্য ভিত্তিতে一

  • মৌসুমি কৃষি,
  • ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি

শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ও বাজারের ভিত্তিতে

(১) আদিম জীবিকাসত্তাভিত্তিক কৃষি : প্রধানত ভরণ-পােষণের তাগিদে গ্রাম্য পরিবেশে যে কৃষিকাজের দ্বারা কৃষক তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্যের সংস্থান করে তাকে আদিম জীবিকসত্তাভিত্তিক কৃষি বলে। এই কৃষি প্রণালীকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一

  • স্থানান্তর কৃষি : যে অস্থায়ী কৃষিব্যবস্থায় অনুন্নত জনগােষ্ঠী প্রাচীন বা আদিম পদ্ধতিতে কেবল নিজেদের জীবিকার প্রয়ােজনে শস্য উৎপাদন করে তাকে স্থানান্তর কৃষি বলে। আফ্রিকায় (কঙ্গো প্রজাতন্ত্র), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (ভারত, শ্রীলঙ্কা) এই কৃষিব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়।
  • স্থায়ী কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় ক্রান্তীয় অঞ্চলের কোনাে কোনাে অংশের অনাবাদি জমিগুলিকে কর্ষণ করে উপজাতি গােষ্ঠীর অধিবাসীরা নিজেদের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য শস্য উৎপাদন করে তাকে স্থায়ী কৃষি বলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে (ভারত, পাকিস্তান), ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যে দেখতে পাওয়া যায়।

(২) বাণিজ্যিক কৃষি : বিরল বসতিযুক্ত অঞ্চলে অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি প্রয়ােগ করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যখন শস্য উৎপাদন করা হয় তখন তাকে বাণিজ্যিক কৃষি বলে। ইউরেশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি, উত্তর আমেরিকার প্রেইরি, দক্ষিণ আমেরিকার পম্পাস-এ এই কৃষি পদ্ধতি দেখা যায়।

(৩) বাগিচা কৃষি : ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে প্রচুর মূলধন, স্থানীয় শ্রমিক, উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, উন্নত পরিকাঠামাে, সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার সাহায্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে রপ্তানি নির্ভর কৃষি প্রণালী গড়ে উঠেছে, তাকে বাগিচা কৃষি বলে। ভারতের চা চাষ, মালয়েশিয়ার রবার চাষ, ব্রাজিলের কফি চাষ প্রভৃতি বাগিচা কৃষির উদাহরণ।

(৪) উদ্যান কৃষি : যে বাজারভিত্তিক কৃষিব্যবস্থায় আধুনিক পদ্ধতিতে বৃহদায়তনে তরিতরকারি, ফল ও ফুলের চাষ করা হয় তাকে উদ্যান কৃষি বলে। উত্তর-পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলিতে (জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি) এই কৃষি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে।


(৫) মিশ্র কৃষি :
যে কৃষিব্যবস্থায় একসঙ্গে ফসল উৎপাদন ও পশুপালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমন্বয় ঘটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে অথচ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিহীন কৃষিকাজ গড়ে ওঠে তাকে মিশ্র কৃষি বলে। ভারতে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও গুজরাতে মিশ্র কৃষি গড়ে উঠেছে।

কৃষি জমির পরিমাণ ও জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে

(১) নিবিড় কৃষি : জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বেশি থাকায় খাদ্যের চাহিদা মেটাতে যতটা সম্ভব বেশি শ্রম ও পুঁজি বিনিয়ােগ করে কম পরিমাণ জমি থেকে যে পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে নিবিড় কৃষি বলে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনবহুল নদীগঠিত সমভূমিতে ধান চাষ, কিংবা উত্তর-পশ্চিম ইউরােপে গম, শালগম, বার্লি প্রভৃতি ফসল উৎপাদন এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন কৃষির মূল বৈশিষ্ট্য।

(২) ব্যাপক কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় কম কায়িক শ্রম অথচ কৃষি যন্ত্রপাতি ও জড় শক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে একসঙ্গে বিশাল আয়তনের জমি চাষ করা হয়, তাকে ব্যাপক কৃষি বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ব্যাপক কৃষি পদ্ধতিতে গম চাষ করা হয়।

আর্দ্রতার তারতম্যের ভিত্তিতে

(১) আর্দ্র কৃষি : জলসেচের সাহায্য ছাড়া নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাতের (150 সেমির বেশি) ওপর নির্ভর করে যে কৃষিকাজ করা হয়, তাকে আর্দ্র কৃষি বলে। মধ্য আমেরিকা ও ব্রাজিলেও আদ্র কৃষির প্রচলন আছে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে আর্দ্র কৃষি পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ হয়।

(২) শুষ্ক কৃষি : যেসব অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম সাধারণত 50 সেমির নীচে এবং জলসেচের সুবিধা নেই সেইসব অঞ্চলে খরা সহ্যকারী শস্যের চাষকে শুষ্ক কৃষি বলে। জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, সালগম প্রভৃতি দানাশস্য এই কৃষির প্রধান ফসল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে (রাজস্থান, পাঞ্জাব, গুজরাত রাজ্যে) এই কৃষি পদ্ধতি প্রচলন আছে।

কৃষিকাজ 6

(৩) সেচ কৃষি : শস্যের জন্য প্রয়ােজনীয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলে অথবা বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হলে কেবল জলসেচের ওপর নির্ভর করে ফসল ফলানােকে সেচ কৃষি বলে। নিম্ন নীলনদ অববাহিকায় ধান, ইক্ষু, ভুট্টা, তুলাে প্রভৃতির চাষ হয়। ভারতে আউশ ও বােরাে ধান এবং রবিশস্যের চাষ সেচের জলে হয়ে থাকে।

কৃষি জমি ব্যবহারের পৌনঃপৌনিকতার ভিত্তিতে

(১) এক-ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় একটি জমিতে বছরে কেবল একটিমাত্র ফসল উৎপাদন করা হয় তাকে এক-ফসলি কৃষি বলে। যাযাবরী কৃষি বা আর্দ্র কৃষিতে এই কৃষিব্যবস্থা দেখা যায়।

(২) দো-ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে সামান্য জলসেচের সুবিধাযুক্ত স্থানে বছরে দুবার ফসল ফলানাে হয় তাকে দোফসলি কৃষি বলে। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশায় খরিফ মরশুমে ধান ও পাট দো-ফসলি কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে চাষ করা হয়।

(৩) বহু ফসলি কৃষি : যে কৃষিব্যবস্থায় একই জমিতে বছরে দুটির বেশি ফসল উৎপাদন করা হয়, তাকে বহু-ফসলি কৃষি বলে। মৌসুমি জলবায়ুর অর্ন্তগত দেশসমূহে এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়।

(৪) ইন্টারক্রপিং বা আন্তঃকৃষি : বহু-ফসলি কৃষিব্যবস্থায় প্রগাঢ় পদ্ধতিতে জমিতে একই সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়। এক এক ফসল এক এক সময়ে। পাকে। তাই, সারাবছর ধরে ফসল ফলানাে ও ফসল তােলা চালতে থাকে। এধরনের কৃষিকাজকে ইন্টারক্রপিং বা আন্তঃকৃষি বলে। ইয়াংসি-কিয়াং নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে এধরনের কৃষিকাজ দেখা যায়।

(৫) শস্যাবর্তন : যে কৃষি পদ্ধতিতে একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করে জমির উর্বরতা বজায় রাখা হয় তাকে শস্যাবর্তন বলে। যেমন—প্রথম বছর যদি কোনাে জমিতে ধান চাষ করা হয় তবে তার পরের বছর আবার ধান চাষ না করে ডাল চাষ করা হয়, আবার তার পরবর্তী বছর ধান চাষ করা হয় এভাবে শস্যাবর্তন কৃষি পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করা হয়ে থাকে।

ঋতুর তারতম্যের ভিত্তিতে

(১) খরিফ কৃষি : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে বর্ষাকালে দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে যে কৃষি প্রণালী গড়ে ওঠে তাকে খরিফ কৃষি বা বর্ষাকালীন চাষ বলে। আমন ধান, পাট, আখ, তুলো প্রভৃতি খরিফ কৃষির মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।

(২) রবি কৃষি : মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে বৃষ্টিহীন শুষ্ক ও শীতল জলবায়ুতে জলসেচের সাহায্যে যে কৃষি প্রণালী গড়ে ওঠে, তাকে রবি কৃষি বা শীতকালীন চাষ বলে। গম, বােরাে ধান, ছােলা, আলু প্রভৃতি এই কৃষির মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।

আঞ্চলিক বিশেষীকরণের তারতম্যের ভিত্তিতে

(১) মৌসুমি কৃষি : মৌসুমি জলবায়ু প্রভাবিত দেশগুলিতে যে জীবিকাসত্তাভিত্তিক, শ্রমপ্রগাঢ়, জলবায়ু নির্ভর কৃষিব্যবস্থা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে, তাকে মৌসুমি কৃষি বলে। সমগ্র পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ লােক এ জাতীয় কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ইত্যাদি দেশে এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়।

২) ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের দেশগুলিতে যে বৈচিত্র্যময় কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি বলা হয়। পশ্চিম ও মধ্য ইউরােপের দেশগুলিতে, মধ্য চিন, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ হয়।

জৈব উপাদান কমে যাওয়ার প্রভাব কী হতে পারে বাংলাদেশের কৃষি জমিতে?

বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে, যার ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের আবাদ হয়।

দেশটির আবাদি জমি, বনভূমি, নদী, লেক, বনাঞ্চল মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর।

কৃষিকাজ 7

জৈব উপাদান কী?

তাদের মতে, মাটিতে যেসব পচনশীল দ্রব্য বা উপাদান থাকে যা বেশি পরিমাণে গাছ ও উদ্ভিদ শোষণ করে থাকে সেগুলোকেই জৈব উপাদান বলা হয়।

তবে এর মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র অণু উপাদানও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নানা ধরণের অণুজীব।

শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শারমিন সুলতানা বলেন, জৈব উপাদানের উপর মাটির জৈব ও রাসায়নিক গঠন নির্ভর করে এবং এটি মাটির পরিবর্তনের সাথেও জড়িত।

তিনি বলেন, “জৈব পদার্থ বেড়ে গেলে মাটির টেক্সচার, স্ট্রাকচার ভাল হয়। মাইক্রো অর্গানিজম অ্যাক্টিভ হয় যেটা গাছের জন্য জরুরী।”

তবে জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ফেলা এবং ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের মতো নানা কারণে এটি কমে যেতে পারে বলে মনে করেন ডঃ শারমিন সুলতানা।

তিনি বলেন, “আবহাওয়া উষ্ণ হলে মাইক্রোঅর্গানিজম সক্রিয় হয়, জৈব উপাদানকে ভেঙ্গে ফেলে। আবার জমিতে যে পরিমাণ জৈব সার দেয়ার কথা সেটি দেয়া হয় না।”

ফসল উৎপাদনে ভূমিকা

এছাড়া নিবিড় চাষাবাদ পদ্ধতিতে একই জমিতে কোন ধরণের বিরতি না দিয়ে বার বার চাষ করাটাও জৈব উপাদান কমাতে ভূমিকা রাখে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈব উপাদান মাটির উর্বরতা ধরে রাখে।

পাশাপাশি, মাটির গুণাগুণ, চাষাবাদ সহজ করা, পানির স্তর ধরে রাখা, বায়ু চলাচলে সহায়তা করে এটি – যা ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এ কারণেই মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ কমে গেলে তা ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে বলে জানাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মোহাম্মদ জাহিদ।

“জৈব উপাদান শুধু পুষ্টি উপাদানের ভাণ্ডার তাই না, এটি পরিমিত ভাবে থাকলে অন্যান্য উপাদান যেগুলো উর্বরতার নিয়ামক সেগুলোর জন্য সহায়ক হয়।”

তিনি বলেন, মাটিতে এই উপাদান কমলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এছাড়া হেক্টর প্রতি যে পরিমাণ ফসল হয় সেটির উৎপাদনও কমে যাবে।

“শুধু বেশি ফলন হলেই হবে না পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য আমরা চাই। জৈব উপাদান নির্ধারণ করে যে ফসলের পুষ্টিগুণ কতটা ভাল হবে।”

রাসায়নিক সার ও কীটনাশক

পুষ্টিবিদরা বলছেন, মাটিতে জৈব উপাদানের ঘাটতি হলে মানুষের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

কারণ মাটির গুণাগুণ কমে গেলে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।

এর ফলে ফসলের খাদ্যগুণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি এগুলো খাবারের মাধ্যমে মানুষের দেহেও প্রবেশ করছে।

বাংলাদেশ ডায়েট কাউন্সিলের প্রিন্সিপাল নিউট্রিশনিস্ট সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, “দেখতে বড়, পচেও না, অনেক দিন থাকছে, কিন্তু পুষ্টিগুণ কম। খেতেও আর আগের মতো স্বাদ-গন্ধ নাই।”

তিনি বলেন, “এখন অনেক নতুন নতুন রোগ হচ্ছে। আগে যেগুলো ছিল না। তার মানে কি? মানে হচ্ছে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হচ্ছে, যার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে।”

Comments (No)

Leave a Reply

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ