সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা।

সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা তিন সন্তান, স্বামী, সংসার—সব সামলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মেয়ে শেখ খাদিজা খানম টপরেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে। পেয়েছেন ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০২৩। তাঁর সফল ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা। 1

সাইনবোর্ড দেখে শুরু

এইচএসসিতে বড় ভাইকে সাবজেক্ট হিসেবে কম্পিউটার নিতে দেখে খাদিজাও আগ্রহী হন কম্পিউটার বিষয়ে। একদিন ব্যাংকে সিরিয়াল নিয়ে বসে ছিলেন। তখন তাঁর নজরে পড়ে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটের একটি সাইনবোর্ড। এটাই যেন খাদিজাকে আরো উসকে দিল ফ্রিল্যান্সিংয়ের পথে।

একদিন চলেই গেলেন ক্রিয়েটিভ আইটির অফিসে। সেখানে জানলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা কাজের বিষয়ে। খাদিজা বলেন, ‘কাজ শিখে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বেতন পাব ডলারে। ভাবতেই পারছিলাম না তখন।

ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট গিয়ে জানতে পারেন বিভিন্ন ব্যক্তির সফলতার গল্প। তখন তাঁর বড় ছেলে স্কুলে পড়ে। সে-ও শিখতে চাইল ফ্রিল্যান্সিং। ২০১৮ সালে খাদিজা গ্রাফিক ডিজাইন অনলাইন কোর্সে আর ছেলেকে ভর্তি করান ওয়েবসাইট ডিজাইন কোর্সে।

কোর্সে অন্যরা তরতর করে এগিয়ে গেলেও খাদিজা অনেক কিছুই বুঝতেন না। তবুও হাল ছাড়েননি। লেগে ছিলেন।

চার ধরনের মার্কেটপ্লেস

২০১৮ সালে ক্রিয়েটিভ আইটিতে গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স করেন। তখন তিনি চার ধরনের মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে জানতে পারেন।

নিজের প্রতি তখন তেমন আত্মবিশ্বাস না থাকলেও খাদিজা চর্চা অব্যাহত রাখেন। রিসেলেবল মার্কেটপ্লেস, কনটেস্ট বেইজড মার্কেটপ্লেস, গিগ বেইজড মার্কেটিপ্লেস, প্রজেক্ট বেইজড মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে জানতে পারেন। খাদিজা বলেন, ‘সাহস করে মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলা কিংবা কাজ করার কথা চিন্তাই করতেই পারছিলাম না তখন, তবে এমনিতেই শিখতে থাকলাম অবসর সময়গুলো অযথা নষ্ট না করে।

সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা। 2

প্রথম আয় ৩০০ ডলার

২০১৯ সালে করোনাকাল খাদিজার জন্য যেন আশীর্বাদ বয়ে আনে। ছেলেদের স্কুল বন্ধ। অনেকটা সময়  ফ্রিল্যান্সিংয়ে দিতে পেরেছেন। ফেসবুক ঘণ্টায় আট ডলার করে ছিল। সর্বমোট ৩০০ ডলারের কাজ করেন তিনি। এটাই ছিল তাঁর প্রথম আয়। ওই সময়ে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এলইডিপি) একটি বেসিক কোর্সও সফলভাবে সম্পন্ন করেন।

অনেক কাজ তাঁর

ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ক্যানভা প্রোর কাজ ভালোই পারেন খাদিজা। আবার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন—ফেসবুক, লিংকডিন, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, কোরা, রেডিট, ইউটিউব, পিন্টারেস্ট ইত্যাদি পেইড মার্কেটিংয়েও তাঁর জুড়ি নেই। ওয়ার্ডপ্লেস থিম অপটিমাইজেশন অ্যান্ড অব পেজ, অন পেজ অ্যান্ড টেকনিক্যাল এসইওয়ের অনেক কাজ তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বলে জানান।

ভিডিও এডিটিংয়ের মধ্যে সোশ্যাল রিল এবং ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার-আপটার ইফেক্ট, প্রিমিয়ার প্রো, ডা-ভিঞ্চি রিসলভে তাঁর দক্ষতা রয়েছে। খাদিজা এ পর্যন্ত ৪০ জন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।

সুখ-দুঃখের সাতকাহন

শুরুর দিকের ঘটনা। দুদিন খেটেখুটে যুক্তরাষ্ট্রের একজন ক্লায়েন্টের কাজ শেষ করেন। এমনও হয়েছে কাজের চাপে রান্না করতে ভুলে গেছেন। বাচ্চারা খাবার চাইলে প্লেট নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখেন রান্নাই তো হয়নি। তখন হোটেল থেকে এনে বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়েছে তাঁকে।

সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা। 3

তার পরও অ্যাড রিভিউতে যাওয়ার জন্য কাজটা বাতিল করে দেন ক্লায়েন্ট।

খাদিজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি তখন ক্লায়েন্টকে বলেন যে রিভিউ করাটা নিতান্তই ফেসবুকের নিজস্ব নিয়মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। তিনি বলেন, ‘সব ধরনের টার্মস, কন্ডিশনস মেনেই অ্যাড সেটআপ করেছি। রিভিউ সব অ্যাডসের বেলায়ই আছে এবং থাকবে, এখানে কারো কিছু তেমন করার নেই।’ অবাক কাণ্ড পাঁচ মিনিটের মাথায় ক্লায়েন্ট জব চালু রাখতে বলেন। শুধু কী তাই। ক্লায়েন্ট খুব খুশি হয়ে ১৪০ ডলার বোনাসও দেন।

প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা

একজন ফ্রিল্যান্সারকে রাত জেগে কাজ করতে হয়। দিনের বেলার অনেক কাজই তাঁর জন্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবারের সবাই কমবেশি সহযোগিতা করলে সমস্যা হয় না। খাদিজা জানান, কাজের বুয়ার পাশাপাশি রান্নাবান্না, বাজারসদাই, বাচ্চাদের স্কুল ম্যানেজ করাসহ সব কিছুতেই তাঁর স্বামী সাহায্য করেন।

ফ্রিল্যান্সার পরিবার

খাদিজার বড় ছেলে কাজী হাসান আবদুল্লাহ ছামি (ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং), মেজো ছেলে কাজী আব্দুর রহমান আবিদ (সোশ্যাল রিল এবং ভিডিও এডিটিং-আফটার ইফেক্ট, প্রিমিয়ার প্রো, ডা-ভিঞ্চি রিসলভ)-এর কিছু কাজ বেসিক থেকে শুরু করে অ্যাডভান্স লেভেল পর্যন্ত পারে। ফলে এদের থেকে খাদিজা প্রয়োজনের সময় সাপোর্ট পান। এতে তাঁর কাজের বোঝাও অনেকটা হালকা হয়।

চট্টগ্রামের মিরসরাই থানার আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং নিজামপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন খাদিজা। এখন বাংলায় অনার্স পড়ছেন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায়।

সংসার সামলে দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন খাদিজা। 4

তাঁর বড় ছেলে কাজী হাসান আবদুল্লাহ ছামি উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে, মেজো ছেলে কাজী আব্দুর রহমান আবিদ অষ্টম শ্রেণিতে, ছোট ছেলে কাজী আজহারুল ইসলাম জারিফ ইংলিশ মিডিয়ামে ইয়ার ফোরে পড়াশোনা করে। স্বামী চা-পাতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পরামর্শ

♦ শুধু যে কাজটা আপনি ভালো পারেন কিংবা যেই জব রিকোয়ারমেন্টের ৮০ শতাংশ কাজ আপনার জানা, শুধু তাতেই অ্যাপ্লাই বা বিড করবেন।

♦ যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন।

♦ যেহেতু ঘরে থেকেই কাজ করছেন; কাজ ফেলে রেখে প্রতিবেশী, মেহমানদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠা যাবে না। কাজ শেষে তাদের সময় দিন। বাসায়ই কাজ করছি বলে একেবারে গাছাড়া ভাব থাকা যাবে না। নিজের কাজের সময়টাকে অফিস আওয়ার ভেবেই কাজ করতে হবে, তা না হলে ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে খুব বেশিদিন লাগবে না। 

♦ আয় যখন নিজের হয় তখন খরচটাও ইচ্ছামতো হয়, এটা থেকে নিজেকে সামলাতে হবে।

♦ যথাযথ ঘুম এবং কাজের সময় নিশ্চিত করতে হবে।

♦ যেহেতু পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজ বেশি করা হয়, তাই তাদের ওখানকার টাইমজোন অনুযায়ী রাতেই বেশির ভাগ অ্যাকটিভ থাকতে হয় বা কাজ করতে হয়, তখন দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়া ইনবক্সে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মেসেজের সম্মুখীন হতে হয়। নানা রকম বিরক্তিকর প্রশ্ন আসতে পারে। এদের কোনো রকম সুযোগ দেওয়া যাবে না।

যেভাবে সামলেছেন সব

ছোট ছেলের বয়স যখন চার বছর তখন খাদিজা ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। ছেলে কোলে নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি ছেলের নানা বাহানা মেটাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন হারহামেশা। দেখা গেছে, ছেলে কম্পিউটারে গেম খেলতে গিয়ে তাঁর প্রয়োজনীয় সব ফাইল ডিলিট করে দিয়েছে। এটাসেটা ডাউনলোড করে প্রায়ই পিসি নষ্ট করে দিত।

টপরেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার

খাদিজার আপওয়ার্কে সম্পন্ন করা কাজগুলোর বেশির ভাগই ফাইভ স্টার রেটিংয়ের। আয়ের চেয়ে দক্ষতা, কাজটা সুন্দরভাবে কারার দিকে তাঁর মনোযোগ বেশি। মার্কেটপ্লেস থেকে এ পর্যন্ত ৮০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেছেন তিনি। মাসে আয় লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে আপওয়ার্কে টপরেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা খুবই কম। খাদিজা আপওয়ার্কে টপরেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

পেয়েছেন পুরস্কারও

নীরবে-নিভৃতে কাজ করতে পছন্দ করেন খাদিজা। তিল তিল করে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। স্বীকৃতিও মিলেছে। ‘নেক্সট ভেঞ্চার প্রেজেন্টস ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সারস কনফারেন্স ২০২৩’-এ দেশসেরা টপ ১৫ জন ফ্রিল্যান্সারের একজন হন তিনি।

যাঁরা ফ্রিল্যান্সিংয়ে লাখোপতি হতে চান

ফ্রিল্যান্সিং এমনই এক পেশা যেখানে স্বল্প সময়ে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করতে চাইলে কী ধরনের দক্ষতা থাকতে হবে জানতে চাইলে খাদিজা বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ে দ্রুত আয় শুধু তখনই সম্ভব যখন বেশ কিছু কাজ অ্যাডভান্স লেভেল এবং বাড়তি কিছু বেসিক কাজও জানা থাকে। পাশাপাশি কমিউনিকেশন স্কিল, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় ভালো দক্ষতা থাকাটা খুব জরুরি।’

নারীদের জন্য কাজ করতে চান

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে খাদিজা বলেন, ‘পরিবারের নারী সদস্য যাঁরা সংসারে অবহেলিত জীবন কাটান, কাজ শিখিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাই। নিজের সন্তানদের পড়াশোনা এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি আইটিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাই এবং ওদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই।’

Comments (No)

Leave a Reply

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ