শখ থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কিচু গল্প নিয়ে এসেছি আজ 2023 শখ! যান্ত্রিকতাময় জীবনের এক ক্ষুদ্র অংশ হলো শখ। শখ আমাদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি কাজেও শক্তি যোগায়। সেজন্য বলা হয় “শখের তোলা আশি টাকা।” সখের তোলা আশি টাকা হোক কিংবা না হোক, কিছু মানুষের জীবনে এই শখগুলোই পেশায় পরিণত হয়।
শখ থেকে স্বাবলম্বী আতিকুল
পড়াশোনার গণ্ডি অষ্টম শ্রেণিতে থেমে যায়। কৃষক পরিবারের সন্তান। সংসারে সাহায্য করতে খেতে নেমে পড়েন আতিকুল ইসলাম। পরে কিছুদিন মাছ চাষ করেন। কিন্তু খুব একটা লাভবান হতে পারছিলেন না। কোয়েল পাখি পালনে শখ ছিল তাঁর। সেই শখই ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠল।
কোয়েল পাখি পালন করে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন আতিকুল। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সদর ইউনিয়নের কেশরতা গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে আতিকুল প্রায় সাত বছর ধরে গ্রামে তাঁর নিজস্ব জায়গায় ‘মায়ের দোয়া কোয়েল ফার্ম’ নামের একটি খামার করে কোয়েল পাখি পালন করছেন। বর্তমানে সেখানে প্রায় তিন হাজার কোয়েল পাখি আছে। খামারে এখন প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার কোয়েল পাখি ডিম দিচ্ছে এবং দেড় হাজার পাখি মাংসের জন্য পালন করা হচ্ছে।
বাড়ির পাশেই কোয়েল পাখির জন্য তিনি ওই খামার তৈরি করেছেন। আতিকুল এবং তাঁর পরিবারের লোকজন খামারের সবকিছু দেখাশোনা করেন। খামার থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ডিম বিক্রি হয় প্রায় দেড় হাজার। প্রতি শ ডিম বিক্রি হয় ২২০ টাকায়।
তিরিশোর্ধ্ব আতিকুল জানান, প্রায় সাত বছর আগে শখের বশে কোয়েল পালন শুরু করেন এবং এতে ব্যাপক সফলতা পান। বর্তমানে এই কোয়েল পাখি নিয়ে চলছে তাঁর বাণিজ্যিক অগ্রযাত্রা। ভবিষ্যতে এই ব্যবসার আরও প্রসার ঘটাতে চান। এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘ভবিষ্যতে প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহযোগিতা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একটি বাচ্চা ফোটানোর যন্ত্রে (ইনকিউবিটর) বাচ্চা উৎপাদনের চিন্তাভাবনা করব।’
আতিকুল জানান, একটি কোয়েল পাখি বছরে ১৫০ থেকে ২০০ ডিম দিয়ে থাকে। প্রতিটি ডিমের ওজন ১৫ থেকে ২০ গ্রাম। বাচ্চা ফোটানোর পর দুই মাস বয়স হলেই এসব কোয়েল পাখি ডিম দিতে শুরু করে। এ ছাড়া কোয়েল পাখির মাংস খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর হওয়ায় দিন দিন এই পাখির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। তা ছাড়া মুরগির ডিম বা মাংসের চেয়ে কোয়েল পাখির ডিম-মাংসের দামেও বেশি পার্থক্য নেই।
আতিকুল কোয়েল পাখির খামার দিয়ে এলাকায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর খামারে উৎপাদিত কোয়েল পাখি ও ডিম দেখে এলাকার কিছু বেকার যুবক উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সহযোগিতা ছাড়াই আতিকুল বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। যদি আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতেন, তাহলে খামারের পাখিদের ইনজেকশন দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতাম।’ তিনি জানান, হাঁস-মুরগির মতো কোয়েল পাখি পালন করে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। কোয়েল পাখির রোগব্যাধি কম। এ জন্য টিকা দিতে হয় না এবং কৃমির ওষুধও খাওয়াতে হয় না। অনেকে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কোয়েল পাখি পালনকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
শখ থেকে স্বাবলম্বী পলাশ
শুরুতে পাখিপালন ছিল শখ। এর পর নেশা, আর নেশা থেকে এখন তা পেশায় পরিণত হয়েছে। পলাশ নামে এক পাখিপ্রেমী বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন বিশাল খামার। তার এই খামারে বিদেশি ৩০ প্রজাতির পাখি ছাড়াও রয়েছে ৪০ প্রকারের ২০০ কবুতর।
পলাশ জানান, খামারে বিদেশি পাখির মধ্যে ম্যাকাও, কাকাতুয়া, আফ্রিকান গ্রেপ্যারট অন্যতম। তিনি প্রতি জোড়া ম্যাকাও আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেন। পলাশের খামারে পাখি ছাড়াও রয়েছে রাশিয়ান তিনটি বিড়াল। যেগুলোর একেকটির দাম ৫০ হাজার টাকার ওপরে। পাখিপালন করে গত চার বছরের ব্যবধানে পলাশ হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী।
নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি তার পাখির খামার বড় হচ্ছে দিন দিন। পাখি কেনা ছাড়াও একনজর বিদেশি পাখি দেখতে অনেকেই ভিড় করেন তার খামারে।বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল পশ্চিমপাড়ার আফতাব উদ্দিনের ছেলে আতিকুর রহমান পলাশ (৩২)। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে সংসারের প্রয়োজনে শুরু করেন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ব্যবসা। ব্যবসার পাশাপাশি ২০০০ সালে নিজের বাড়িতে শখ করে কিছু কবুতর পালন শুরু করেন। একপর্যায়ে পাখিপালন তার নেশায় পরিণত হয়। প্যাকেজিং ব্যবসা করে কিছু টাকা জমলে তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ২০০৬ সালে ব্যবসা ছেড়ে পাড়ি জমান মালয়েশিয়া। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বিদেশি পাখি প্রতিপালন করতে দেখেন তিনি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করলেও ভাগ্যের তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। এর পর দেশেই কিছু করার আশায় পাখি প্রতিপালনে ঝুঁকে পড়েন।
পলাশ জানান, মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি প্রতিপালন তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন। এ কারণে দেশে ফিরে বিদেশি জাতের পাখি এবং নানা প্রজাতির কবুতর নিয়ে একটি খামার গড়ার ইচ্ছায় বাড়ির পাশেই একটি টিনশেড ঘর তোলেন। সেই সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বেশকিছু পাখি সংগ্রহ করেন।
এতে তার বিনিয়োগ করতে হয় আড়াই লাখ টাকা। ওটাই তার মূল বিনিয়োগ। এর পর নতুন করে তেমন বিনিয়োগ করতে হয়নি খামারে। কারণ জানতে চাইলে পলাশ বলেন, জোড়া হিসেবে পাখি কেনার ফলে তারা খামারেই এসে বংশবিস্তার শুরু করে। ফলে খামারের পরিধি বেড়ে যায়।
তিনি নিজে খামার সামাল দিতে না পারায় দিনচুক্তি তিনজন লোক রেখেছেন। তারা পাখির খাবার সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং আনুষঙ্গিক দিকগুলো দেখেন। আর তিনি এসব পাখি কেনাবেচা করেন।পাখি পরিচর্যার আপডেট তথ্য কীভাবে পান? এমন প্রশ্ন করলে পলাশ বলেন, এখন ইন্টারনেটেই সব জানা যায়। গুগলে সার্চ দিলেই রোগব্যাধি এবং তার প্রতিকার যেমন জানা যায়;
একইভাবে কোন প্রজাতির পাখি কী খাবার খায় সেটাও জানা সম্ভব। তবে মাঝেমধ্যে তিনি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেন।খামারের কর্মী বাদল মিয়া জানান, খামারের বেশ কয়েক প্রজাতির পাখি পোষ মেনেছে। প্রতিটি পাখির আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। তারা খাঁচা থেকে বের হয়ে উড়ে গেলেও নাম ধরে ডাকলে আবার ফিরে আসে। অনেকটা মানুষের মতো কথাও বলতে পারে বেশ কয়েকটি পাখি।
বাদশা আরও বলেন, প্রতিদিনই নানা পেশার মানুষ খামারেই আসেন পাখি দেখতে ও কিনতে।গোকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সওকাদুল ইসলাম সরকার সবুজ জানান, শৌখিন মানুষরা পলাশের খামারের পাখির ক্রেতা। বিদেশি জাতের পাখি ভালো দামে কেনাবেচা হয়। আমাদের যুব সমাজ পলাশের মতো নিজেরাই চেষ্টা করলে বাড়িতে থেকেও ভালো উপার্জন করে স্বাবলম্বী হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
শখ থেকে স্বাবলম্বী ইয়াসমিন
সফল উদ্যোক্তা ইয়াসমিন আকতার। বাড়ি নাটোরের সিংড়া পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর দমদমা গ্রামে। শখের বসে শুরু করেছিলেন গরু পালন। শখ থেকে এখন স্বাবলম্বী তিনি। নারীরা যে শুধু সংসারের দৈনন্দিন কাজের মধ্যই নয়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ভূমিকা রাখতে পারে তারই উদাহরণ ইয়াসমিন। ইয়াছমিন আকতার সপ্না, একজন সফল ডেইলি অ্যান্ড এগ্রো খামারি। শুধু খামারিই নয়, পাশাপাশি একজন ফ্রিল্যান্সার।
জানা যায়, দিনে সংসারের কাজ খামার দেখাশোনা ও বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে আসা যাওয়া করেন তিনি। রাতে ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজ করেন ইয়াসমিন। ডিজিটাল মার্কেটিং, ভিডিও এডিটিং, ওয়েব ডিজাইনার হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়া ঘাস চাষে একজন সফল কৃষক তিনি। সাংসার জীবনে ইয়াসমিন আকতার এক কন্যা সন্তানের জননী। মেয়ে জেনি, বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের মেধাবী ছাত্রী। স্বামী জাহিদ হাসান কীটনাশক ব্যবসায়ী।
ইয়াসমিন আকতার বলেন, হাইড্রোপনিক ঘাস চাষ শুরু করেছি এক বছর আগে। বর্ষার সময় এই ঘাস সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তাছাড়া খরচও কম। এই ঘাস চাষ করে নিজেদের চাহিদাও মেটানোর পাশাপাশি বিক্রিও করছি।
তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সালের শেষে শখের বসে একটা গাভি দিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করি। আল্লাহর রহমতে আমার আর পিছনে তাকাতে হয়নি। নিজের কঠোর পরিশ্রম দিয়ে শখ থেকে করা খামার এখন বাণিজ্যিক রুপ নিয়েছে। এখন আমার খামারের ১১টা গরু আছে। চারটি গাভি দুধ দেয় প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজি। দুধ বিক্রি করে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে ১০-১৫ হাজার আয় হয়। আমার ইনকাম বছরে প্রায় ৭-৮ লাখ। ইচ্ছা আছে অনেক বড় খামার করার।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সেলিম রেজা বলেন, আমি তার বিষয়টি শুনেছি। সরেজমিনে গিয়ে তার কাজ দেখার ইচ্ছে রয়েছে। সব সময় কৃষি বিভাগ তার পাশে থাকবে বলে জানান তিনি।
শখ থেকে ভেড়া পালন করে এখন স্বাবলম্বী সাইদুল ইসলাম
শখের বসে চার বছর আগে ভেড়া পালন শুরু করেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের সাইদুল ইসলাম। আর এ শখই এখন রুপ নিয়েছে বাণিজ্যিক খামারে। বর্তমানে যা থেকে বছরে আসে প্রায় তিন লক্ষ টাকা উপার্জন করছেন তিনি।
খামারি সাইদুলের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই ভেড়া পালনের শখ ছিল। পূজি সংকট ও ব্যস্ততার কারণে সময় হয়ে উঠেনি তার। তিনি চার বছর আগে তাঁর ইচ্ছে আরও দৃঢ় হয়ে উঠে। তখন দুই টি মহিলা ভেড়া ও একটি পুরুষ ভেড়া ২ হাজার ৩ শত টাকা দিয়ে কিনে ভেড়া পালনের যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রথম বছর ভেড়াগুলো থেকে বাচ্চা হয় না।
তার পরের বছর থেকে মা ভেড়াগুলো বাচ্চা দিতে শুরু করে এবং লাভের মুখ দেখতে পান তিনি। এ শখকে পুঁজি করেই নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন খামার। বর্তমানে তার খামারে ১৪ টি ভেড়া রয়েছে। ভেড়া গুলোর মহিলা ভেড়ার সংখ্যায় বেশি রয়েছে। এ ভেড়া পালনের জন্য নিজ বাড়িতে একটি আধাপাকা ঘর তৈরি করে খামার করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, এই খামার থেকে গত ঈদুল ফিতর থেকে ঈদুল আজহা পযন্ত ৩০ টি ভেড়া বিক্রি করেন। তার সংসারে স্ত্রী, ১ ছেলে এবং ১ মেয়ে নিয়ে ৪ জনের সংসারে ভেড়া পালন করে বেশ ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মা ভেড়া বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়। কারো খামারে ২০ টি মা ভেড়ার খামার থাকে তাহলে বছরে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় করা যাবে এবং তা দিয়ে আমার মত ছোট সংসার ডাল ভাত নয়, মাছ,গোস্তো ভাত খেয়ে চলে যাবে। ভেড়া পালন করে অল্প পুঁজিতে অতি সহজেই বেকারত্ব দূর করা যায়।
স্থানীয়রা সাইদুলের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, তার ভেড়া পালন দেখে অনেক বেকার যুবকও আগ্রহী হতে পারেন এবং ভেড়ার খামার করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসার মো.নাজমুল হোসাইন জানান, উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিস থেকে খামারিদের চিকিৎসাসহ সকল পরামর্শ দেয়া হয়। অন্যান্য পশুর তুলনায় ভেড়া পালন লাভজনক। এছাড়াও এর মাংসের পরিমান ও স্বাদ অনেক বেশি। তাই আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ভেড়া পালন অধিক লাভজনক।
শখের বশে যমুনা চরে ক্যাপসিকাম চাষে স্বাবলম্বী রুবেল
বাহারি রঙের বিদেশি সবজি ক্যাপসিকাম। এটি মিষ্টি মরিচ নামে পরিচিত। ভিটামিন এ ও সি সমৃদ্ধ এ সবজির বড় ক্রেতা শহরাঞ্চলের বড় বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টে। একসময় শহরের সৌখিন মানুষ বাসার ছাদে টবে এ সবজির লাগালেও বর্তমানে শত শত বেকার যুবক এ সবজি চাষে ঝুঁকছে।
কম পরিশ্রমে অধিক লাভবান হওয়ায় যুবসমাজের কাছে কদর বাড়ছে ক্যাপসিকাম চাষের। গাছ লাগানোর ৩৫ দিনের মধ্যে ফুল আসতে শুরু করে, এরপর পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই বিক্রির উপযুক্ত হয় এই সবজি।
তেমনি সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের যমুনার বালুচরে শখের বশে ক্যাপসিকামের চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন কৃষক রুবেল। এ বছর তার ক্যাপসিকামের বাম্পার ফলনও হয়েছে। কৃষক রুবেল তরফদার উপজেলার নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়নের চরদোরতা গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে।
রুবেল বলেন, একই উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের কৃষক জহুরুল ইসলামের ক্যাপসিকাম চাষ দেখে আমার আগ্রহ বাড়ে। তার থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে গত বছর প্রথমে ৩২ শতাংশ জমিতে ক্যাপসিকাম চাষাবাদ শুরু করি। ১৬ হাজার টাকায় ৪০ গ্রাম বীজ কিনে এনে শখের বশে চাষাবাদ শুরু করে এখন আমি সফলতা পেয়েছি।
তিনি বলেন, চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে আমি প্রায় এক লাখ টাকা খরচে করে ক্যাপসিকামের চাষ করি। জহুরুল ইসলামের পরামর্শতে জমিতে সার প্রয়োগ করে চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত করে বীজ বপন করি।
স্বপ্নবিলাসী আত্মপ্রত্যয়ী রুবেল বলেন, শুরুতে এলাকার লোকজন নানা রকম মন্তব্য করতো, চাকরি বাদ দিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে অপরিচিত এই সবজির চাষ শুরু করায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, অনেকে পাগলও বলতো। তবে আমি দমে যাইনি। ইতোমধ্যেই তিন ধাপে প্রায় ৭০ হাজার টাকার মতো ক্যাপসিকাম বিক্রিও করেছি।
তিনি বলেন, আশা করি এই মৌসুমে প্রায় আড়াই-তিন লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করতে পারবো। একসময় যারা রুবেলের ক্যাপসিকাম চাষ নিয়ে নানা বিদ্রুপ করতো তাদের মধ্যে অনেকেই এখন স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাপসিকাম চাষের চিন্তা করছেন।
স্থানীয় কৃষক মোতালেব মিয়া বলেন, প্রথমে গ্রামের অনেকেই অনেক কথা বলতো, এখন তারাও ক্যাপসিকাম চাষের প্রতি ঝুঁকছে।
কৃষক রুবেল তরফদারের জানান, স্থানীয় কৃষি অফিসে ক্যাপসিকাম চাষের ব্যাপারে সহযোগিতা ও পরামর্শ চেয়েছি। সরকারি সহায়তা পেলে ব্যাপক হারে চাষাবাদ করে এলাকায় বেকারদের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারবো বলে বিশ্বাস।
এ বিষয়ে কাজিপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রেজাউল করিম জানান, কৃষক রুবেল তরফদারকে ক্যাপসিকাম চাষের পরামর্শ দেওয়া হবে। এছাড়া তাকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
মধু চাষে স্বাবলম্বী শিক্ষক দম্পতি
শখ থেকেই মধু চাষ শুরু করেন শিক্ষক দম্পতি রাশেদুল ইসলাম তপন ও গোলাপজান। তবে এখন তা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষক দম্পতির বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশাতে হলেও বিভিন্ন ফসলের সময় তারা বিভিন্ন জেলায় চলে যান।
বর্তমানে তারা ঢাকার ধামরাই উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের সানোড়া গ্রাম থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সরিষা আবাদ শেষের দিকে। তাই এই এলাকা থেকে তারা ফের অন্যত্র চলে যাবেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রাজবাড়ীর পাংশা এলাকার শাহ মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম তপন ও তার স্ত্রী গোলাপজান শখ করে ২টি মধুর বক্স কেনেন ১৪ হাজার টাকায়। সাথে কিছু মৌমাছিও ক্রয় করেন। এতে মোট তাদের ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। ৫ দিন পর তারা ৪ কেজি মধু পান সেখান থেকে।
সেই ২টি বক্স থেকে এখন হয়েছে ১০০টি। বড় হয়েছে তাদের ব্যবসা। বর্তমানে ধামরাইয়ের সানোড়া এলাকায় ৫ হাজার টাকা দিয়ে জায়গা ভাড়া করে মধু চাষ করে যাচ্ছেন।
রাশেদুল ইসলাম রাজবাড়ীর পাংশার আইডিয়াল গার্লস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের শিক্ষক এবং স্ত্রী গোলাপজান একই জেলার আগুড়া ডাংগী আব্দুল মাজেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
তারা বলেন, ২০১৯ সাল অর্থাৎ ২ বছর ধরে মধু চাষ শুরু করলেও বর্তমানে ভালো অবস্থানে আছি। একটু একটু করে বিনিয়োগ করে আজ শখের পেশাটি বড় হয়ে গেছে। ৭ দিন পরপর মধু সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ৭-৮ মণ মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
তারা বলেন, ধামরাইতেই মধু বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তারপর কিছু ঢাকা ও রাজবাড়ীতে পাঠাতে হয়। চাহিদা প্রচুর। ‘ন্যাচারাল পিওর হানি’ নাম দিয়ে উৎপাদিত মধু বাজারজাত করেন তারা।
বর্তমানে হালিম সরদার, আশরাফুল ইসলাম, খোকনসহ ৪-৫ জন লোক প্রতিদিন এই শিক্ষক দম্পতির সাথে মধু সংগ্রহে কাজ করেন। প্রতিটি বক্সের মধ্যে একটি করে রানী মৌমাছি থাকে। বছরে প্রায় ৫ মাস মধু সংগ্রহ করা যায়। বাকি ৭ মাসই এই মৌমাছিকে খাওয়াতে হয়। রানী মৌমাছি বেঁচে থাকে দেড় থেকে দুই বছর সময়।
যে জমি থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করেন তারা, সেই জমির ফলন ২০% বেড়ে যায়। তবে ধামরাইয়ে আরো কয়েকটি এলাকার মধু সংগ্রহ করা হয়। তারা অনেকে ধামরাইয়ের স্থানীয় বাসিন্দা, আবার অনেকে বাহির থেকে ধামরাই গিয়ে এই ব্যবসা করে আসছে। পোলেন নামক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাবার মৌমাছিকে দিতে হয়। তাছাড়া মৌমাছি মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ, বাঙ্গালপাড়া, হাজিপুর ও কুশুরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মধু সংগ্রহ করা হয়। শুধু মধু সংগ্রহই নয়, এই শিক্ষক দম্পতি নিজ এলাকায় প্রথমে রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণ করেন। তারপর নিজেদের জমিতে বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক বন তৈরির কাজ চালু করেছেন।
এছাড়াও নিজ জমিতে ১০০টি বারোমাসি আম গাছ, ১০০টি মাল্টা গাছ, ১০০টি কুল গাছসহ মোট ৫ প্রকারের ৫০০টি ফলের গাছ লাগানো হয়েছে।
শিক্ষক হলেও প্রকৃতির প্রতি টান প্রচুর। পরিবারের দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য তিনি শখ করে একটি গরু ক্রয় করে লালন পালন করেন। সেখান থেকে আজ তার গরুর খামার হয়ে গেছে।
শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম জানান, গাছিরা মৌচাকে চাপ দিয়ে মধু সংগ্রহ করে। এতে মধুর গুণাগুণ ৪০% নষ্ট হয়ে যায়। আর আমরা খামারে যন্ত্রের সাহায্যে বাতাস দিয়ে মধু সংগ্রহ করি। এতে আমাদের মধুর গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
তিনি আরো জানান, আমাদের মধু যদি সরকারিভাবে বিক্রির কোন ব্যবস্থা হয়, তাহলে আমরা মৌ খামারিরা আরো বেশি লাভবান হতে পারবো।
রাশেদুল ইসলামকে এসব কাজে সবসময় উৎসাহ ও সহযোগিতা করে থাকেন তার স্ত্রী গোলাপজান। তবে বাণিজ্যিকভাবে মধু খামার করে ভ্রাম্যমাণ মধু খামারি রাশেদুল ইসলাম দুই বছরের মাথায় আজ স্বাবলম্বী।
তিনি আশা করেন, বাংলাদেশের মৌ খামারিদের মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হবে। আবার অনেকের মধু বিদেশে যাচ্ছেও।
রাশেদুল ইসলাম এরপর ফরিদপুর জেলার ঝাজিড়া এলাকায় যাবেন। সেখানে প্রচুর কালোজিরা ও ধনিয়া পাতা চাষ হয়। সেখান থেকে প্রচুর মধু সংগ্রহ করা যায়। তারপর যাবেন ইশ্বরদী লিচুর এলাকায়।
কৃষক আব্দুল বারেক বলেন, আমাদের এলাকায় যদি আরো বেশি মধু সংগ্রহ করা হতো, তবে ফসলের উৎপাদন আরো বেড়ে যেত।
ধামরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফ হাসান বলেন, ধামরাইতে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। যদি প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া সরিষা নষ্ট না হয়, তবে খামারিরা প্রায় ৫ টন মধু সংগ্রহ করতে পারবে।
বুটিক শিল্প শখ থেকে সাফল্য
রোমেনা আক্তার মনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। দিনাজপুরের হাকিমপুর নারী উদ্যোক্তা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক তিনি। তার সেলাই কারখানায় কাজ করেন চারজন কারিগর। কারিগরদের প্রাপ্তি পারিশ্রমিক দিয়েও মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।
শখের বশে সেলাই শিখে তিনি আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয় রোমেনা আক্তার মনির পথ চলা। বিয়ের পর নিজ কন্যাসন্তানের পোশাকাদি তৈরি করবেন, এমন শখের বশে সেলায়ের কাজ শিখেন তিনি তার বড় বোনের নিকট।
পরবর্তীতে সেই শখের শেখা কাজ আজ পেশায় রূপ নিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে শখের সেলাইকে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে কাজে লাগান রোমেনা আক্তার। শুরু করেন নিজ হাতের তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের লেডিস পোশাক অনলাইন-অপলাইনে বেচাকেনার। তখন থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
চলছেন তিনি আপন শক্তিতে। রোমেনা আক্তার মনির ইচ্ছে নিজেকে স্বাবলম্বীর পাশাপাশি হাকিমপুরের বেকার নারীদেরও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলবেন। তাই তিনি হাকিমপুর নারী উদ্যোক্তা ফোরাম একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের তিনি সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। সংগঠনটিতে রয়েছে ৩৬ জন নারী সদস্য।
প্রত্যেক নারী সদস্যরাই এক একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠেছেন। হাকিমপুর শহরের সিপি রোডস্থ রোমেনা আক্তার মনির বসতবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন পোশাকের শোরুম। রয়েছে সেখানে তার সেলাই কারখানা। সেলাই কারখানায় কাজ করেন চার জন পুরুষ কারিগর।
রোমেনা একজন দক্ষ কাটিং মাস্টার। তার কারখানায় তৈরি হয় নারীদের সবধরনের পোশাক। বিভিন্ন ডিজাইনে কাপড় কাটেন তিনি, আর কারিগররা আপনমনে তা সেলাই করেন। আবার কাপড়ে নানা রকমের ফুলও তৈরি করেন তিনি। এসব ডিজাইনের পোশাকের ব্যাপক চাহিদা তার অনলাইন ও অফলাইনের ক্রেতাদের কাছে।
তার ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে। মূলত সেই পেজের অনলাইন থেকেই তিনি প্রচুর অর্ডার পান। বর্তমান অনলাইন-অপলাইনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন তিনি। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে কাজের অর্ডার। অনেক সময় নিজে কাপড় কাটতে এবং কারিগররা তা সেলাই করতে হিমশিম খাচ্ছেন। সকাল ৯টা থেকে কারিগরদের সেলাই কাজ শুরু হয়, তা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।
প্রত্যেক কারিগরের মজুরি প্রতিদিন দিয়ে দেন তিনি। এতে তারা পায় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি। সব মিলে রোমেনা আক্তার মনি প্রতি মাসে বেচা-বিক্রি ও অর্ডারি কাজ করেন ১ লাখ ৫০ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তা থেকে তার মাসিক আয় হয়ে থাকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। স্বামী-সন্তান ও সংসারের সকল চাহিদা মিটিয়ে এসব কাজ করেন তিনি।
নিজেকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি চারজন কারিগরদের সুন্দর একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এই নারী উদ্যোক্তা রোমেনা আক্তার মনি। চারজন কারিগর বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবত মনি আপার সেলাই কারখানায় কাজ করে আসছি। এখানে আমাদের কাজের কোন অভাব হয় না। প্রতিদিন হাতে অনেক কাজ পেয়ে থাকি, তবে আগে যখন বাজারে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করতাম তখন অনেক সময় হাতে তেমন কাজ থাকত না।
এখানে আমরা অনেক ভাল আছি, প্রতিদিন প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকার সেলাই কাজ করে থাকি। হাকিমপুর নারী উদ্যোক্তা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রোমেনা আক্তার মনি বলেন, শুরুটা শখের বশেই আমার এই কাজ, পরে পেশা হিসাবে নেয়া। আমার ইচ্ছে হাকিমপুরের নারীদের নিয়ে কাজ করব।
তাই হাকিমপুর নারী উদ্যোক্তা ফোরাম তৈরি করেছি। আমরা নারীরা অবহেলিত নই, পুরুষের মতো আমরাও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে পারি। আমি আমার কারখানায় নিজের কাজের পাশাপাশি নারীদেরও সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমি চাই নারীদের বেকারত্ব দূর করতে। তারা কাজ শিখে নিজ বাড়িতে বসে কাজ করবেন এবং তাদের সংসারকে সহযোগিতা করবে। সেই সঙ্গে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলবেন।
Comments (No)