ফেরারি আসামি থেকে সফল ব্যবসায়ী বব উইলিয়ামসন। আমেরিকার একজন সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। যাঁর জীবনকে সিনেমার কাহিনীর চেয়েও বিস্ময়কর বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন, মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী, ডাকাত এবং ফেরারি আসামি।
একসময় পুরোপুরি বদলে যান। গড়ে তোলেন নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ উদ্যোক্তা। বদলে যাওয়ার বিস্ময়কর কাহিনী উঠে এসেছে বব উইলিয়ামসনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মিরাকল অন লুকি স্ট্রিট’-এ। নিজ মুখেই শোনা যাক তাঁর সেই গল্প।
‘বাবা বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন সেই সুবাদে দেশের অনেক জায়গা ঘুরেছি, শিখেছি; কিন্তু ভালো মানুষ হতে পারিনি। আমি ১২ বছর বয়স থেকে ড্রিংক করা শুরু করি, ভয়ংকর সব মাদক নেওয়া শুরু করি ১৭ বছর বয়সে। অপরাধপ্রবণতাসহ নানা কারণে ১৯টি স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে আমাকে। একসময় হেরোইনে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি।
ফলে আমার দিন-রাত অনেকটা রাস্তায় কাটতে থাকে। এভাবেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভবঘুরে হয়ে পড়ি। অর্থের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ি। একসময় পুলিশের খাতায় একজন বড় অপরাধী হিসেবে আমার নাম উঠে আসে। পালিয়ে বাঁচতে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
চলতে চলতে পৌঁছালাম আটলান্টায়। আমার সেই যাত্রা শেষ হয়েছিল লুকিস্ট্রিটে।’
সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে মনে হলো আরেকবার চেষ্টা করে দেখি না। ভালো হওয়ার অন্তত একটি পথ চাই, এমন ভাবনা আমার মনের মধ্যে শুরু হলো। হাতে টাকা নেই। তাই সাত ডলারে এক
ব্যাগ রক্ত বিক্রি করে রাতে থাকার জন্য লুকিস্ট্রিটে
একটি রুম ভাড়া করলাম। পরের দিন একটি কাজ পেলাম দৈনিক ১৫ ডলারে। এরপর জীবন আবার নতুন করে শুরু করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু তখনও ভাগ্য আমার পক্ষে আসেনি। মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। সেখানে দীর্ঘ সময়ের বিরক্তি কাটাতে আমি বাইবেল পড়া শুরু করি।
নাস্তিক হওয়ায় ভাবতাম এর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত হতে পারব না। তবুও শুধু সময় কাটাতেই এই অবলম্বন; কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে আমি নিউ টেস্টামেন্টের প্রত্যেকটি শব্দ পড়েছি, এরপর ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং আবার নিউ টেস্টামেন্ট পড়লাম। এবং এই সময় থেকে আমার মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন আসতে লাগল।
বলতে দ্বিধা নেই আমার চরিত্র ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। মাদক সেবন থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা আমি করিনি। ভেবেছিলাম এ পাপ থেকে আমি কখনো মুক্তি পাব না; কিন্তু বাইবেল আমাকে নতুন পথ দেখাল। ক্ষমা এবং নিজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে নম্রতা, ভদ্রতা এবং ধৈর্য আমার মধ্যে উদ্ভাসিত হতে শুরু করল। আমি অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেলাম। মাদক এবং ড্রিংক ছেড়ে দিলাম।
হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। ছয় মাস পর আমরা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। স্ত্রীকে অতীত জানাইনি। বিয়ে করার পর ভাবলাম এভাবে জীবন কাটবে না, আমার কলেজ সার্টিফিকেট নেই তাই কঠিন পরিশ্রম করেই বেঁচে থাকতে হবে। স্ত্রীর সহায়তায় ‘গ্লিডেন পেইন্ট কম্পানি’ নামক একটি রঙের কম্পানিতে সবচেয়ে নিম্নমানের চাকরিটি পেলাম। মাসে ৩৫০ ডলার।
আমার কাজ ছিল কারখানার ফ্লোর থেকে শুরু করে সব দেয়াল পরিষ্কার করা, প্রয়োজনে রং করা এবং সার্বিক তত্ত্বাবধান করা। খুব মনোযোগ সহকারেই কাজগুলো করতাম। নিজে নিজে কিছু পেইন্টও করতাম। ফলে আমার কাজে খুশি হয়ে কম্পানি আমাকে আটবার পদোন্নতি দিল। আমি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে উঠে এলাম। এরপর বুঝতে পারলাম নিজেই একটি ব্যবসা খুলতে পারি।
১৯৭৭ সালে এক হাজার ডলার ঋণ নিয়ে গড়ে তুললাম ‘ওয়াইল্ডলাইফ আর্টিস্ট সাপ্লাই কম্পানি’ (ওয়াস্কো)। আমরা বড় বড় কম্পানিগুলোর পেইন্টিংয়ের নানা কাজ করে দিতাম। ফলে কয়েক বছরের ব্যবধানে আমি মিলিয়নেয়ারে পরিণত হলাম। হঠাৎ করে কিছু ঝামেলায় পড়ে বাধ্য হয়ে কম্পানি বিক্রি করে দিই; কিন্তু এখান থেকে আরো ভালোভাবে শিখলাম কিভাবে ব্যবসা চালাতে হয়।
গ্লিডেন কম্পানিতে আমি কম্পিউটারসংশ্লিষ্ট কিছু কাজ করেছি। তখন দেখেছি কিভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে এবার আমি একজন প্রগ্রামারকে ভাড়া করি এবং একটি সিস্টেম ডেভেলপ করি। ১৯৯২ সালে আমি ‘হরিজন সফটওয়্যার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে নতুন একটি সফটওয়্যার কম্পানি শুরু করি। আমার ছেলেরা মেধাবী সফটওয়্যার ডেভেলপার ছিল।
ফলে তারা আমার সহায়তায় এগিয়ে এলো। আমরা প্রথমেই স্কুল লাঞ্চ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সফটওয়্যার তৈরি করি। ক্রমান্বয়ে এটিকে স্কুলে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য তৈরি করি। ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুলগুলো আমার সফটওয়্যার লুফে নেয়।
ক্রমান্বয়ে এ সফটওয়্যার স্কুল থেকে শুরু করে হাসপাতাল, কলেজ, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে কিছু সমস্যার কারণে আমি ৭৫ মিলিয়ন ডলারে হরিজন বিক্রি করে দিই। ওই বছরই গড়ে তুলি স্পা এবং রিসোর্ট কম্পানি ‘হানি লেক প্লান্টেশন’। এভাবে ১১টি কম্পানি গড়ে তুলেছি।
‘বাকি জীবনে আমার মিশন হচ্ছে মানুষকে সহায়তা করা এবং তারা যেন হতাশ না হয় তা বোঝানো। কারণ আমার মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা ছিল তা থেকে আমি একজন সিরিয়াল কিলার হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ঈশ্বর আমাকে সিরিয়াল উদ্যোক্তায় পরিণত করেছেন।
স্রষ্টা সুযোগ দেবেন, আমাদের দায়িত্ব সে সুযোগ কাজে লাগানো। এ জন্য প্রয়োজন জীবনের লক্ষ্য স্থির করা, কৌশল নির্ধারণ করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ বব উইলিয়ামসন বর্তমানে উইলিয়ামসন গ্রুপ ইউএসএ এবং হানি লেক রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। হাফিংটনপোস্ট, আইএনসি ডটকম।
Comments (No)