পণ্য সরবরাহ এখনো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা অনলাইনভিত্তিক দুই হাজার নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণে আগামীকাল ৬ অক্টোবর রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার, বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) শুরু হচ্ছে দুই দিনের উই সামিট। উইমেন অ্যান্ড ই–কমার্স (উই) ট্রাস্ট এর আয়োজক।
এ বছর চতুর্থবারের মতো সামিটের আয়োজন করা হচ্ছে। উইয়ের ফেসবুক গ্রুপের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৪ লাখ। এবারের সামিট ও উইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে ২ অক্টোবর রাজধানীর বনানীতে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন উইয়ের প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসিডেন্ট ও অন্যতম ট্রাস্টি নাসিমা আক্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পল্লব মোহাইমেন
উই সামিট কেন?
নাসিমা আক্তার
প্রতিবছর আমরা (উই) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করি। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর উইয়ের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাস অক্টোবরে ২০২০ সাল থেকে উই সামিটের আয়োজন করা হচ্ছে। সামিটে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারক,
করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকে। এসব আলোচনা থেকে তাঁরা বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পান। আর ফেসবুক গ্রুপে থাকা উদ্যোক্তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ বা নেটওয়ার্কিং হয় এ আয়োজনে। এবারে চতুর্থ সামিট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নাসিমা আক্তার, উইয়ের প্রেসিডেন্ট ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যুগ্ম সম্পাদক
এবারের আয়োজনের বিশেষত্ব কী?
প্রতিবছরই সামিটে অংশগ্রহণকারীদের জন্য একটি থিম থাকে। এবারে আমরা গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশক বেছে নিয়েছি। এই দুই দশকে দুই ধরনের নারীদের আমরা দেখি। একটি অংশ ঘরের সবকিছু সামলেছেন। সন্তানদের তৈরি করেছেন।
আরেক অংশ ঘর থেকে বেরিয়ে চাকরি করেছেন বা ব্যবসায় করেছেন। আমাদের বর্তমান গড়ে দিতে এই ধরনের নারীরই অনেক অবদান। এবারের সামিটে যাঁরা অংশগ্রহণ করবেন, সবাই সত্তর ও আশির দশকের সাজে আসবেন। সামিট আমাদের উইবাসীদের (উইয়ের সদস্য) জন্য বিশেষ একটি দিন।
আপনি বললেন নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সমস্যা থাকে। সামিটে কী ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে?
আমরা বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি। সামিটের দুই মাস আগে থেকে আমি বিভিন্ন জেলায় যাই। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলি। কোথায় কী সমস্যা, তা বের করার চেষ্টা করি। সে অনুযায়ী সামিটে আলোচনা বা বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করি। এবারে যে সমস্যা প্রধানত চিহ্নিত করেছি, সেটি হলো আমাদের উদ্যোক্তারা পণ্য সরবরাহ সঠিকভাবে করতে পারছেন না। স্থানীয় পর্যায়ে ও শহরের বাইরে—দুই জায়গাতেই সঠিকভাবে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
বিশেষ করে উপজেলাভিত্তিক ডেলিভারি সেন্টার (পণ্য সরবরাহ কেন্দ্র)। কিছু কিছু জেলায় সরকারের ডিজিটাল সেন্টার নেই। বরিশালের কয়েকটি উপজেলায় ইন্টারনেটই নেই। ইন্টারনেট ছাড়া তো আমাদের উদ্যোক্তারা প্রায় অচল।
আরেকটি সমস্যা হলো সাইবার নিরাপত্তা। অনেক পেজ জনপ্রিয় হওয়ার পরও বন্ধ হয়ে যায়। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারেও আমাদের কাজ করতে হবে। সামিটে এসব বিষয়ে যথাযথ দিকনির্দেশনা পাওয়ার চেষ্টা করব।
সেলিব্রিটিদের (তারকা) নিয়ে প্যানেল আলোচনা থাকবে। শিরোনাম: আমার স্বপ্ন, আমার পরিচয়। এখানে তারকারা তাঁদের কষ্ট করে এগিয়ে চলার কথা বলবেন। অনেকে জীবনের কঠিন অংশ, হতাশা কীভাবে পার করেছেন, সেটা বলবেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ অধিবেশনও থাকবে সামিটে। পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়েও আলোচনা হবে। দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ৭ অক্টোবর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে কর্মশালা থাকবে।
আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় জানাটা জরুরি। দ্বিতীয় দিনে এবারের জয়ী পুরস্কার দেওয়া হবে। উইয়ের সদস্যদের মধ্যে ১০ জন পাচ্ছেন এই পুরস্কার। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন এমন ১০ নারীকেও জয়ী সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে উই গ্রুপে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
এখন উই গ্রুপের সদস্য ১৪ লাখ ৩৮ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে চার লাখ উদ্যোক্তা। উইতে ক্রেতাও আছে, বিক্রেতাও আছে। একজন তাঁর পণ্য যেমন বিক্রি করছেন, তেমনি আরেকজনের পণ্য কিনছেন।
২০২১ ও ২০২২ সালে সদস্য সংখ্যা বাড়ার হার কমেছিল। তবে এখন আবার বাড়ছে। অনেক গ্রুপ ছিল নারী উদ্যোক্তাদের, বেশ কিছু গ্রুপ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আবার সদস্য বাড়ার হার ঊর্ধ্বমুখী।
নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যোগের ধরনে কোনো পরিবর্তন এসেছে?
হ্যাঁ। আগে নারী উদ্যোক্তা মানেই শুধু শাড়ি বিক্রেতা বোঝা যেত। এখন নারীদের পণ্য শুধু শাড়িতে সীমাবদ্ধ নেই। পাটজাত পণ্য, কাগজের গয়না, হস্তশিল্পের পণ্য বেড়েছে।
উইয়ের উদ্যোক্তাদের পণ্যে কোনগুলো এগিয়ে আছে?
শীর্ষে পোশাক। এরপরে আছে খাবার। পরের তিনটি হলো গয়না, হস্তশিল্প এবং পাট ও চামড়াজাত পণ্য।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য উই আসলে কী করে?
সদস্যদের জন্য দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয় উইমেন অ্যান্ড ই–কমার্স ট্রাস্ট। ডিজিটাল বিপণনে সহায়তা করা হয়। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়াতে আমাদের উদ্যোক্তাদের নিয়ে গিয়ে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। যাঁরা গেছেন, তাঁরা ফিরে এসে ওই সব দেশে পণ্য রপ্তানি করছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল, হোটেলের সঙ্গে উইয়ের চুক্তি আছে, ফলে সদস্যরা এসব জায়গায় বিশেষ ছাড় পান। প্রতি মাসে উই একজন উদ্যোক্তাকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয়। এটা হচ্ছে তাঁকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। উই হাটবাজার নামে আয়োজন হয়ে থাকে দেশের ৬৪ জেলায়। পয়লা বৈশাখে মেলার মতো এই আয়োজন করি আমরা।
উইয়ের তহবিল পান কীভাবে?
উই অলাভজনক সংগঠন। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আমরা চারজন। আমরা অনুদান দিয়ে তহবিল গঠন করি। প্রশিক্ষণ থেকে আয় হয়। আন্তর্জাতিক তহবিলও পেয়েছি। ফেসবুক থেকেও একটা অনুদান উই পেয়েছে। বিভিন্ন আয়োজনে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে উইয়ের নারী উদ্যোক্তাদের একটা অনুদান দেওয়া হয়েছিল গত বছর। সেটি কীভাবে বিতরণ করা হয়েছে?
২০২০ সালের সামিটে উই থেকে আমরা আইসিটি বিভাগের কাছে নারী উদ্যোক্তাদের অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করি। পরে সিদ্ধান্ত হয় এক হাজার উদ্যোক্তার প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ও ১৮ সেপ্টেম্বর এই অনুদান দেওয়া হয়। উইয়ের ৭০০ উদ্যোক্তা এই অনুদান পেয়েছেন। ফরম পূরণ করে যাঁরা পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে অনুদানের জন্য নির্বাচন করেছে আইসিটি বিভাগ। পরে তাঁদের ডেকে অনুদানের চেক দিয়েছে।
একজন নারী উদ্যোক্তা কেন উইয়ের সঙ্গে যুক্ত হবেন?
এখানে যুক্ত হলে একটা পরিবারের পরিবেশ পান। এখানে তিনি নিজে তাঁর পণ্যের ক্রেতা পান আবার ক্রেতা হিসেবে নিজেও পণ্য কিনতে পারেন। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পান। বিদেশি প্রশিক্ষকেরা যুক্ত থাকছেন। এখন তো দেশের বাইরে থেকেও অনেকে যুক্ত হচ্ছেন।
সামিট কতটা সফল হবে বলে মনে করেন?
নিবন্ধন করে দুই হাজার নারী এবার সামিটে অংশ নিচ্ছেন। আমাদের উইবাসীদের জন্য এই সামিট ঈদের মতো আনন্দের। সবাই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি।
Comments (No)