দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত

দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত 1

দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেমের গল্পগুলো শুনতাম। তখন থেকেই দেশের জন্য কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছা কাজ করত মনে। জীবনে বড় কোনো কিছু হতেই হবে এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু হ্যাঁ, জীবনে দেশের জন্য কিছু করতে হবে এটা আমাকে সবসময় ভাবাতো।

যখন দেশের মাটিতে না থেকেও দেশের খবরগুলো পড়তাম, দেখতাম, শুনতাম তখন দেশের মানুষের জন্য কিছু একটা করার তাড়না কাজ করত আমার মধ্যে। আর সেই তাড়না থেকেই স্বপ্ন দেখি মানুষের কোনো একটা সমস্যা সমাধানের। উদ্যোগ নেই ‘পার্কিং কই’ আইডিয়াটা বাস্তবায়নের। স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিল। স্বপ্নে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন পালক।

এভাবেই নিজের স্বপ্নের উদ্যোগের কথা জানালেন ‘পার্কিং কই’ উদ্যোগের স্বপ্নদ্রষ্টা মো. রাফাত রহমান।

দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত 2

উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে তার দেশপ্রেমটাই কাজ করেছে বেশি, যা তিনি ছোটবেলা থেকেই মনে লালন করে আসছিলেন। বড় হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সেটা বাড়তেই থাকে। এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা।

রাফাতের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর হলেও তার বেড়ে উঠা ও শিক্ষা জীবন কাটে চট্টগ্রামে। মা-বাবা ও এক বোনের ছোট পরিবার। বর্তমানে তার জীবনসঙ্গী সামিহা চৌধুরীসহ পরিবারের সবাই থাকেন আমেরিকাতে।

এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন বিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন ডিজনিতে কনফিগারেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। গত ১২ বছর ফরচুন ৫০০ কোম্পানিসহ ৮-১০টি কোম্পানিতে কাজ করেছেন।

এর মধ্যে ইন্টেল, এইচপি, জেপিমর্গান ও ব্যাংক অব আমেরিকা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে কাজ করছেন আমেরিকার সবচেয়ে বড় কার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গাইকোতে। একই সঙ্গে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পার্কিং প্ল্যাটফর্ম ‘পার্কিং কই’তে।

‘পার্কিং কই’ উদ্যোগের আইডিয়াটা রাফাতের মাথায় আসে একটু নাটকীয়ভাবে। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টে অ্যাপ নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। পৃথিবীতে মানুষ প্রতিনিয়ত যে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে, সেগুলোর সমাধান এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন নিয়েই ছিল তার প্রধান কাজ। কাজের সুবাদে রাফাত একদিন যান নিউইয়র্কে।

সেখানে গাড়ি নিয়ে কাজের উদ্দেশে বের হলে নিউইয়র্কের বাঙালি এলাকায় গাড়ির পার্কিং নিয়ে তাকে পড়তে হয় প্রচণ্ড সমস্যায়। তখনই তিনি অনুভব করেন উন্নত বিশ্বের শহরগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও গাড়ির পার্কিং নিয়ে রয়েছে অনেক সমস্যা।

২০১৭ সালের মাঝামাঝি যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন তখনও তাকে পোহাতে হয় একই সমস্যা। বিষয়টা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এ সমস্যা সমাধানে কাজ করলে তো মন্দ হয় না। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ‘পার্কিং কই’ প্রজেক্টটি নিয়ে কাজ করার।

তারপর শুরু হয় আইডিয়াকে বাস্তবায়নের সব ধরনের পরিকল্পনা ও কার্যক্রম। প্রজেক্ট প্ল্যান তৈরি, আয়-ব্যয়, হিসেব-নিকাশ, সুবিধা-অসুবিধা সব কিছু। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে আলোর মুখ দেখে প্রজেক্টটা। ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ অ্যাপটি আনুষ্ঠানিক লঞ্চ করা হয়।

দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত 3

‘পার্কিং কই’ প্রতিনিয়ত কাজ করছে নিরাপদ পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে দেয়ার জন্য। দিনে ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহে ৭ দিন, মাসিক কিংবা ঘন্টাভিত্তিক পার্কিং সেবা দিচ্ছে ‘পার্কিং কই’ উদ্যোগ

শুধু ‘পার্কিং কই’ উদ্যোগের মাধ্যমে ঘণ্টা অনুযায়ী ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত লোকেশন ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়া যে কোনো ব্যক্তির বাসার সামনের খালি জায়গা, গ্যারেজ, বাগান ইত্যাদি পার্কিং সার্ভিস দিয়েও আয় করা সম্ভব ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

প্রথম সপ্তাহেই ৫ হাজার ডাউনলোড নিয়ে অ্যাপটি বাংলাদেশের ট্রাভেল এবং ট্রান্সপোর্টেশন বিভাগের টপ ওয়ানে চলে আসে। এরপরে উদ্যোগটি নিয়ে গ্রামীণফোন প্রি-এক্সেলেটরে ট্রাই করলে চলে যায় টপ ফাইভে। সেখানে তিন মাস ধরে উদ্যোগে উপরে বিজনেস প্ল্যান, ভিশন, কাজের ধরন নিয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়। কিছুটা সিট ফান্ডিংও পায় উদ্যোগটা।

এ বিষয়ে রাফাতের ভাষ্য, এই সিড ফান্ডিং এবং ট্রেনিং নিয়েই আসলে এগিয়ে যেতে থাকি। তিন মাস পরে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা গ্রাজুয়েট হয়ে বের হই। এরপর আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রায় দেড় বছরে ‘পার্কিং কই’ গাড়ির চালকদের মধ্যে বেশ ভালো সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। গুগল প্লে-স্টোরে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ইতোমধ্যেই ৮০ হাজার বার ডাউনলোড করা হয়েছে। ঢাকায় ১০টি এবং চট্টগ্রামে ৫টির উপর হাবিং পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। উদ্যোগটি ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে পার্কিংয়ের সেবা দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশে যে কোনো নতুন আইডিয়াকে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করা, এটা কি, কেন মানুষ ব্যবহার করবে, কীভাবে ব্যবহার করবে, ব্যবহার করলে কী লাভ হবে এসব ঠিকঠাক মতো বুঝানোটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আইডিয়ার সাথে মানুষের পরিচয় হতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। রাফাতের বেলায়ও তাই হয়েছে। তার এই স্বপ্নটা পূরণ করা এতটা সহজ ছিল না।

চ্যালেঞ্জের বিষয়ে রাফাত বলেন, কাজটা করতে গিয়ে সবথেকে বেশি যে জিনিসটা বুঝেছি সেটা হলো, মানুষ তার স্বভাবগত নিয়মে চলতে অভ্যস্ত। নতুন নিয়মে আসতে অথবা মানতে তাদের একটু সময় লাগে। তেমনি ‘পার্কিং কই’ এর মাধ্যমে পার্কিংয়ের যে নিয়ম তা জনগণকে জানানো, বুঝানো এবং সেবাটাতে তাদের অভ্যস্ত করাটাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার এবং আমার টিমের জন্য।

দেশপ্রেমের টানেই উদ্যোক্তা হলেন ইঞ্জিনিয়ার রাফাত 4

রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যার নাম হচ্ছে যানজট। ঢাকাবাসীর কেউ চাইলেই যানজট এড়িয়ে তার প্রতিদিনের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন না। আর তার অন্যতম কারণ যত্রতত্র পার্কিং। নগরীর ব্যস্ততম সড়কগুলোর পাশে গাড়ি পার্ক করে অনেকেই চলে যান অফিসে, কিংবা চলে যান শপিংয়ে। আর তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের অনেক ভবনেই নেই পার্কিং সুবিধা। ‘পার্কিং কই’ সেবাটি নগরবাসীর গাড়ির চালকদের জন্য অনেকটা উপকারে আসবে। বললেন রাফাত।

যানজটের এই ব্যস্ত নগরিতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ‘পার্কিং কই’ উদ্যোগটি গাড়ির চালকদের জন্য অনেকটা স্বস্তি ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অ্যাপটি গত এক বছরে শহরে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ একবার হলেও ব্যবহার করে পার্কিংয়ের সুবিধা নিয়েছেন। একটু একটু করে প্রতিদিন বাড়ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা।

উদ্যোগটি নিয়ে রাফাতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে অনেক। বর্তমানে প্রতি মাসে গ্রোথ ২৫ শতাংশ। ইতোমধ্যেই ৮০ হাজার ব্যবহারকারী এবং ২৫ হাজারের বেশি ভেরিফাইড পার্কিং স্পেস রয়েছে। এটিকে ১ লাখ পার্কিং স্পেসে নিয়ে যেতে চান রাফাত। ২০২১ সালের মধ্যেই রাজধানীর ৭০ শতাংশ পার্কিং সমস্যা এবং ২৫ শতাংশ ট্রাফিক সমস্যার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে দেশপ্রেমী এই উদ্যোক্তার। শুধু দেশেই নয়। 

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইতোমধ্যে নেপালেও শুরু হয়েছে ‘পার্কিং কই’ উদ্যোগটির কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশের প্রধান শহরে কার্যক্রম বিস্তারের স্বপ্ন দেখেন রাফাত।

Comments (No)

Leave a Reply

এই সাইটের কোন লেখা কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ