দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে লতিফার অদম্য সংগ্রাম লতিফার ট্রেনিং সেন্টারে এ পর্য়ন্ত অন্তত ৫ হাজার শিক্ষার্থী কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যাদের অনেকেই দেশ-বিদেশে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেকে সাবলম্বী কিংবা উদ্যোক্তা হয়েছেন।
নিজের ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা লতিফা আক্তার
লতিফা আক্তারের গল্পটা হতে পারত হতাশার
তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকেছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে আত্মহত্যা কিংবা হাল ছেড়ে দেওয়ার কথাই ভাবে। ব্যবসায় স্বামীর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত তিন সন্তান নিয়ে সংগ্রাম করে যাওয়া একজন নারীর মনে এরকম চিন্তা আরও জোরালো হয়েই উঁকি মারবে।
কিন্তু লতিফা হতাশায় দমে যাওয়ার চিরচেনা পথে হাঁটেননি।
লতিফার অদম্য ইচ্ছাশক্তি শুধু তার পরিবারকেই দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করেনি, বরং এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে। এই পথে হেঁটে তিনি কেবল নিজের ভাগ্যই ফেরাননি, বরং দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তরুণদের।
১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় লতিফার। বিয়ের কয়েক বছর পর দেখেন, স্বামীর ব্যবসার অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। তাই স্বামীকে সাহায্য করতে নিজে কিছু করার তাগিদে ১৯৯৬ সালে বুটিক ও কুকিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন লতিফা।
ওই বছরই নিজের বাসায় ছোট পরিসরে বুটিকস ও প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন তিনি। পরের বছর ১৯৯৭ সালে শুরু করেন ফুড ক্যাটারিং ও কুকিং প্রশিক্ষণ।
এরপর ১৯৯৯ সালে বিয়ের দেনমোহর ও ব্যবসার জমানো মোট ৩ লাখ টাকা দিয়ে লতিফা নগরীর কাতালগঞ্জে বড় পরিসরে গড়ে তোলেন ‘ফ্যাশন ম্যাক্স’ বুটিক হাউস।
বড় বিনিয়োগে ব্যবসা শুরু করলেও প্রথম কয়েক বছর তেমন ব্যবসা হয়নি ফ্যাশন ম্যাক্সের। দোকান ভাড়া, কর্মী ও কারিগরের বেতন—সব মিলে প্রতি মাসে বড় অংকের লোকসান গুনতে হতো।
লতিফার ভাগ্য প্রসন্ন হয় ২০০৩ সালে। ওই বছর আশপাশের কয়েকটি স্কুলের স্কুলড্রেসের অর্ডার পান তিনি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।
প্রতিবছর নগরীর বেশ কয়েকটি স্কুলের স্কুলড্রেস তৈরি করার কাজ পাওয়ার সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ৫০-৬০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এভাবে প্রায় এক দশক ভালোই ব্যবসা করেন লতিফা।
এর মধ্যে তিনি নিজের পড়ালেখা ও সংসারও চালাতে থাকেন সমান তালে। এসএসসির পর বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও এরমধ্যে এইচএসসি, ডিগ্রি ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। ২০০৮ সালে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে ডিপ্লোমা করেন ভোগ ফ্যাশন ইনস্টিটিউটের স্থানীয় শাখা থেকে।
ফের নিঃস্ব হয়ে পড়া
ফ্যাশন ম্যাক্সের ব্যবসার পরিমাণ দেখে লতিফাকে ঋণ দিতে তৎপর হন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। প্রথমদিকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করলেও পরে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পীড়াপীড়িতে আর নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি।
নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সহজে পাওয়া ব্যাংকঋণ গ্রহণ করেন লতিফা। কিন্তু নিজের ব্যবসার জন্য নেওয়া ঋণ বিনিয়োগ করেন স্বামীর ব্যবসায়। উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়া স্বামীকে ফের ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা।
কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত পরে তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
লতিফার স্বামী এবার কাঠের ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেও সেখানেও বড় অঙ্কের লোকসান করে বসেন। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে খেলাপি হয়ে পড়েন সফল এই নারী উদ্যোক্তা।
একপর্যায়ে ব্যবসায় অনিয়মিত হয়ে পড়েন লতিফা। লোকসানে পড়ে দীর্ঘসময় লাভে থাকা ফ্যাশন ম্যাক্সও।
তিনি বলেন, ‘স্বামীর ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে ব্যবসায় নামি। ব্যবসার মুনাফার টাকা ও ব্যাংকঋণ নিয়ে তুলে দিই স্বামীর হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি আমার প্রতিষ্ঠান ও আমাকে ঋণখেলাপিতে পরিণত করেন।
‘কিন্তু আমি দমে যাইনি। বাড়ি ও জমি বিক্রি করে ব্যাংকঋণ ও মানুষের পাওনা মিলে প্রায় ৩ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছি। এসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। এখনও কিছু ব্যাংক ঋণ আছে। ব্যবসার আয় থেকে প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা সমন্বয় করছি।’
ফিরে আসা
২০১৭ সালে আবারও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন লতিফা। তবে এবার তার প্রধান ফোকাস ছিল ট্রেনিং সেন্টার নিয়ে। বুটিক হাউসের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য আগের ‘ফ্যাশন ম্যাক্স’কে ‘এফএম স্কিল একাডেমি’ নামে গড়ে তোলেন।
পাশাপাশি ওই বছরেরই জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টনি খান ইনস্টিটিউট অব স্কিলস ডেভেলপমেন্ট ফর কালিনারি অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট চট্টগ্রাম’। বেকারি অ্যান্ড পেস্ট্রি, ফ্রন্ট অফিস, হাউসকিপিং, হোটেল ম্যানেজম্যান্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে।
অন্যদিকে সেলাই, বুটিক, ফ্যাশনের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এফএম স্কিল একাডেমিতে।
উদ্যোক্তা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি
লতিফা বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান দুটিতে এক-দেড় মাসের কোর্স থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা চালু হয়েছে। এসব কোর্সের ফি ৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত।’
ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের বিষয়ে লতিফা বলেন, ‘যখনই বুটিকস নিয়ে প্রশিক্ষণ নিই, তখন থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল নিজের আয়ের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা তৈরি করা। তাই নিজের ব্যবসা শুরুর সাথে সাথেই ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তুলি।’
তবে দেশে-বিদেশে এখন দক্ষ রাঁধুনির চাহিদা বাড়ায় আগের সেই গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানকে এখন ইনস্টিটিউট হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন বলে জানান তিনি।
একসময় শুধু নারীরা কুকিং প্রশিক্ষণ নিলেও এখন ছেলেরাও কুকিংয়ে আসছেন বলে জানান তিনি। লতিফার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভালোভাবে কাজ করছেন তারা।
শুরু থেকে এ পর্য়ন্ত অন্তত ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন লতিফা, যাদের অনেকেই দেশ-বিদেশে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেকে সাবলম্বী কিংবা উদ্যোক্তা হয়েছেন।
ভবিষ্যতে এই ইনস্টিটিউটকে একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চান লতিফা। তিনি বলেন, ‘আমার সেই সাহস ও শক্তি আছে। এখন দরকার বিনিয়োগ সহায়তা। কিছু বিনিয়োগ পেলে ইনস্টিটিউটকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিতে পারব।’
চলতি বছরের অক্টোবরে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোকে ‘স্কিলসেট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে একীভূত করা হয়, যার প্রোগ্রামগুলো জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে।
‘শ্রেষ্ঠ মা’
গত বছর চিটাগং উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (সিডব্লিউসিসিআই) ‘শ্রেষ্ঠ মা’ সম্মাননা পেয়েছেন লতিফা আক্তার।
সিডব্লিউসিসিআইয়ের সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, ‘এত ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও তিন সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এক কদমও পিছ পা হননি লতিফা। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করেছেন। নিজে যেটা লালন করেন, কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে সন্তানদের সেই পেশায় এনেছেন।’
বর্তমানে লতিফার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন তার তিন সন্তান। তারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পলিটেকনিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
লতিফার বড় মেয়ে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলএম শেষ করে মায়ের ব্যবসার হাল ধরেছেন। ছেলে ঢাকার রয়েল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে মাস্টার্স করছেন। ছোট মেয়ে চট্টগ্রামের মহসিন কলেজে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করছেন।
Comments (No)