ডিলারশিপ ব্যবসা বেশ লাভজনক একটি ব্যবসা। ডিলার নিয়োগ চলছে এরকম নামি-দামি কোম্পানির অসংখ্য বিজ্ঞপ্তি পত্রিকাতে বা অনলাইনে দেখা যায়।অনেকে হয়তো এই ধরণের বিজ্ঞাপন দেখেন কিন্তু বুঝতে পারেন না কিংবা জানতে চান, কিভাবে শুরু করবো ডিলারশিপ ব্যবসা?
আনন্দের বিষয় হল, ডিলার ব্যবসায় ঝুঁকি তুলনামূলক কম এবং লাভের পরিমাণ বেশি। কেননা, এখানে আপনার পণ্যের বিজ্ঞাপন করা লাগছে না, ক্ষেত্র বিশেষ পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে পণ্যের মেয়াদ উর্ত্তীন হয়ে গেলেও তার দায় ভার কোম্পানি বহন করে।
যাইহোক লাভ-লসের হিসাব সহ সবকিছুই আমরা এই লেখায় আলোচনা করবো। তাই কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। আর পড়ার ফাকে পড়ে নিতে পারেন ১৪ টি ডিলারশিপ ব্যবসায়ের আইডিয়া।
ডিলারশিপ ব্যবসা
ডিলারশিপ ব্যবসা কি?
ডিলারশিপ ব্যবসা হচ্ছে কোন কোম্পানির একটা নিদিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা। অর্থাৎ, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো পাইকারি বা খুচরা বাজারে বিক্রয় করা।
কোন কোম্পানির ডিলারশিপ নেওয়ার মানে হল, একটি নিদিষ্ট এলাকায় ঐ কোম্পানির পণ্যের বিপণন এবং বণ্টন, সহ যাবতীয় কাজের দায়িত্ব পালন করা। আর যিনি এই দায়িত্ব পালন করেন তাকে ডিলার বলা হয়। এই ব্যবসায় যেমন ঝুঁকি কম, তেমনি লাভের পরিমাণও বেশি।
তবে, এই ব্যবসাটি শুরু করার জন্যে আপনার দরকার মার্কেটিং প্ল্যানিং, উপস্থিত বুদ্ধি এবং বাজার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা আপনার কাছ থেকে নিদিষ্ট পরিমাণ মাল নিয়ে বিক্রি করবে। আর আপনি যত বেশি মালামাল তাদের কাছে বিক্রি করতে পারবেন, আপনার লাভের পরিমাণও তত বেশি হবে।
নতুন ব্যবসা শুরু করার আগে মাথায় রাখুন ১২টি বিষয়
কেননা কোম্পানি মাল বিক্রি করার জন্যে আপনাকে একটা নিদিষ্ট পরিমাণ কমিশন দিবে। ধরুন কোন কোম্পানি যদি আপনার এলাকায় ডিলার নিয়োগ করতে চায়। আর আপনি যদি সেটি নিতে চান তাহলে, চুক্তিমত সেই এলাকায় পণ্য বিপণন সহ সেই কোম্পানির যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আপনার মাধ্যমে সেই এলাকায় দেওয়া হবে। একজন ডিলার শুধুমাত্র একটা কোম্পানির ডিলারশিপ নিবে তা নয়, সে চাইলে আরও ১০-১২ টি কোম্পানির ডিলারশিপ নিতে পারবে।
ডিলারশিপ নিতে কি কি লাগবে?
- সর্বপ্রথম নিজের একটা ফার্ম বা এজেন্সি লাগবে।
- যে কোম্পানি থেকে ডিলারশিপ নিবেন সেই কোম্পানির নিকট রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
- একটা ট্রেড লাইসেন্স থাকা লাগবে।
- নিজের একটা ব্যাংক একাউন্ট লাগবে।
আপনার অফিস প্রোফাইল
উপরের কাজগুলো করা হয়ে থাকলে এরপর লাগবে আপনার অফিসের একটা প্রোফাইল।
অফিস প্রোফাইলের মধ্যে যেসব বিষয় অর্ন্তভুক্ত:
- আপনার অফিসটি কোথায় অবস্থিত।
- অফিসে গোডাউন আছে কিনা, থাকলে সেটা কতো বড়।
- আপনার অফিসে কতজন কর্মচারী কাজ করে।
- আপনি মালামালগুলো কোন এরিয়ায় বিক্রি করতে চান।
এইসব বিস্তারিত তথ্য দিয়ে নিজের অফিসের একটা প্রোফাইল তৈরি করে কোম্পানির নিকট পাঠাতে হবে।
কোম্পানির সাথে চুক্তিপত্র
আপনাকে কাঙ্ক্ষিত কোম্পানির সাথে একটা চুক্তি পত্র করতে হবে এবং সেই চুক্তি পত্রে সাইন করতে হবে।
চুক্তিপত্রে যেসব বিষয় থাকবে:
- আপনি কোম্পানি থেকে কি কি প্রোডাক্ট নিতে চান।
- কি পরিমাণ নিতে চান।
- কোম্পানি কি পরিমাণ কমিশন দিবে আপনাকে।
- ট্রাক বা অন্য কোন ট্রান্সপোর্ট দিয়ে মাল কোম্পানি আপনার গোডাউনে পাঠাবে ইত্যাদি।
সব কিছু সেই চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকবে। আপনার সব রিকুয়ারমেন্ট যদি সেই চুক্তি পত্রে উল্লেখ থাকে তবে, আপনি সেখানে সই করবেন। তারপর আপনার ব্যবসা শুরু করবেন।
ডিলার চুক্তিতে যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে:
- ডিলার চুক্তির আগে তাদের কোম্পানি বা অফিসে গিয়ে দেখে আসুন। এছাড়া, তাদের গোডাউন বা যেখানে উৎপাদন করে সেসব স্থানগুলো পরিদর্শন করে আসুন। প্রয়োজনে এই কোম্পানির অন্যান্য ডিলারদের সাথে আলোচনা করুন।
- আপনার নিকট কোম্পানি কিভাবে পণ্য পাঠাবে সেটা নির্ধারণ করে নিন।
- মেয়াদার্ত্তীন পণ্যের ক্ষেত্রে নিয়ম কি হবে এবং পণ্য প্রেরণের ক্ষয় ক্ষতি কে বহন করবে সেটা নির্ধারণ করুন।
- কোম্পানি এসআর নিয়োগ করবে কিনা। এই বিষয়টি নির্ধারণ করে নিন। কেননা, কোম্পানি এসআর নিয়োগ করলে তার বেতন কোম্পানি দিবে।
- ডিলারশিপ চুক্তি বাতিল করার নিয়ম-কানুন ঠিক করে নিন। যেন কেউ চাইলে নিজের ইচ্ছামত ডিলারশিপ চুক্তি বাতিল করতে না পারে।
ডিলারশিপ ব্যবসা পুঁজি
সব ব্যবসার মতো এই ডিলারশিপ ব্যবসায়ও ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন হয়। তবে এই ব্যবসার ইনভেস্টমেন্টটা একটু আলাদা রকমের হয়ে থাকে। দুইভাবে ইনভেস্টমেন্ট করা যায় এখানে।
সিকিউরিটি মানি ইনভেস্টমেন্ট: প্রায় সব কোম্পানিই তাদের কাছে কিছু টাকা ডিপোজিট রাখে সিকিউরিটি হিসাবে। সেটা একবারে নিয়ে নেয় না। আপনার সাথে কোম্পানির চুক্তি শেষ হলে, তারা সেই টাকাটা আপনার কাছে ফিরিয়ে দিবে। কোম্পানি অনুযায়ী সিকিউরিটির টাকার পরিমাণ বিভিন্ন হয়। যেমন কোন কোম্পানির সিকিউরিটি ২০ হাজারও হতে পারে, আবার কোন কোম্পানির সিকিউরিটি ২ লক্ষ টাকাও হতে পারে। আবার কোন কোম্পানির সিকিউরিটি ৫০ লক্ষ টাকাও হতে পারে। এটা নির্ভর করে কোম্পানিটি কতটা বড় আর পরিচিত। কোম্পানির ভ্যলু যত বেশি হবে, তার সিকিউরিটির পরিমাণও বেশি হবে।
প্রোডাক্টের খরচ বিনিয়োগ: আপনি যেই প্রোডাক্ট নিচ্ছেন তার দামের একটা নিদিষ্ট অংশ কোম্পানিকে অগ্রিম দিতে হবে। ধরেন আপনি এক ট্রাক সয়াবিন তেল আনছেন কোম্পানি থেকে, তাহলে প্রথমেই আপনাকে অর্ধেক তেলের দাম দিয়ে মালটা আনতে হবে, বাকি টাকাটা পরে দিয়ে দিবেন।
ডিলারশিপ ব্যবসা আয়
ডিলারশিপ ব্যবসা আয় হয় মূলত শীতকালে। তবে, বর্ষাকালে আয় কিছুটা কম হয়। আর আপনি যদি বিভিন্ন কোম্পানির ডিলার নিয়ে পণ্য বিক্রি করেন তাহলে, লাভ তুলনামূলক অনেক বেশি হবে।
কিভাবে ডিলারশিপ নিবেন?
আপনি যে কোম্পানি থেকে ডিলারশিপ নিবেন, তাদের ওয়েবসাইটে ডুকে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। তাদের কোম্পানি নিয়ে রিসার্চ করুন। তাদের কার্যক্রম আপনার পছন্দ হলে তাদের সাথে কন্টাক্ট করুন। এছাড়া, আপনার এলাকায় যদি কোম্পানির কোন লোকাল ব্রাঞ্চ থাকে তবে, তাদের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করুন।কোম্পানির প্রতিনিধি দল এসে নিশ্চিত করবে, সবকিছু ঠিক আছে কিনা। সব কিছু ঠিক থাকলে তবেই আপনি কোম্পানির ডিলারশিপ পেতে পারেন।
ডিলারশিপ পণ্য
- ইলেকট্রনিক্স পণ্য যেমন: ওয়ালটন, সিঙ্গার, স্যামসাং ইত্যাদি ব্রান্ডের ডিলার।
- গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ডিলার।
- খাবারের পণ্য যেমন: প্রাণ, আকিজ গ্রুপ, স্কয়ার, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা ইত্যাদি ব্রান্ডের ডিলার।
- নির্মাণ সামগ্রীর ডিলার যেমন: বিভিন্ন কোম্পানির রড, সিমেন্ট ইত্যাদি।
- কৃষি পণ্যের ডিলারশিপ। ২০টি লাভজনক কৃষি ব্যবসা আইডিয়া।
- আসবাবপত্রের ডিলারশিপ।
- মিনারেল ওয়াটারের ডিলার ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর ডিলারশিপ নিতে পারেন।
ডিলারশিপ ব্যবসা সতর্কতা
- আপনি যে এলাকায় পণ্যটি বিক্রি করতে চাচ্ছেন সেই এলাকায় পণ্যটির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে কিনা সেটিও জানা জরুরি আপনার জন্যে। আপনি এমন একটি পণ্য বিক্রি করতে চাচ্ছেন যেটি সেই এলাকার মানুষের তেমন চাহিদাই নাই তাইলে সেটি আপনার ব্যবসার জন্যে ক্ষতিকর হবে।
- বর্তমানে অনেকে ডিলারশিপ ব্যবসা করে প্রতারিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ মূলত পূর্বে ডিলার সম্পর্কে যাচাই বাছাই না করা। সাধারণত এ ধরণের প্রতারণার শিকার হতে হয়, নতুন কোম্পানি কিংবা ফেসবুকে পাওয়া চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে।
- অনেকে ফেসবুকে চটকদার ডিলার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখে ডিলার নেয় এবং পরবর্তীতে কোম্পানি থেকে আর টাকা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন নিউজ সহ পত্র-পত্রিকায় এই খবর উঠে এসেছে। তাই এই বিষয়ে অবশ্যই সর্তক থাকবেন।
- চুক্তির কপিটি স্থায়ী করতে রেজিস্ট্রেশন করে রাখুন। এতে করে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে না। কেননা, অনেক সময় কোম্পানি কোন কারণ ছাড়াই চুক্তি বাতিল করে দিতে পারে।
পরিশেষে
ডিলার ব্যবসা করে লাখপতি হয়েছে এমন উদাহরণ যেমন অসংখ্য রয়েছে। তেমনি রয়েছে অসংখ্য ব্যর্থতার গল্প। তাই যেকোনো ব্যবসা শুরু করার পূর্বে ভালভাবে সে বিষয়ে জেনে শুনে নামাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়ার ৫টি কারণ।